উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর নওগাঁ জেলার স্বনামধন্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নওগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এটি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন নিরঞ্জন কুমার মণ্ডল। শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সৃজনশীল পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখার গুরুত্ব ও ভালো ফলাফলের জন্য তাদের করণীয়সহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন নওগাঁ প্রতিনিধি— বাবুল আখতার রানা
প্রশ্ন : প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সব স্তরেই পাসের হার বেড়েছে। তবে শিক্ষার সামগ্রিক গুণগতমান বেড়েছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। শিক্ষার গুণগতমান প্রত্যাশা অনুযায়ী না বাড়ার কারণ কি?
উত্তর : শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন রয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক। শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই মনে করে সর্বোচ্চ ফলাফলের সনদ পাওয়াটাই বড় কথা। এ মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকদের জবাবদিহিতা, প্রশিক্ষণ ও সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ প্রয়োজন। এজন্য শিক্ষকদের পেশার প্রতি আন্তরিক হওয়া দরকার।
প্রশ্ন : শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকরা কি ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো বিকশিত করতে পারেন। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও পেশার প্রতি আগ্রহ দেখাতে হবে। শিক্ষকতা মহৎ পেশা। তাই এ পেশাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। এই পেশায় নীতিহীন ও মানসিক শ্রমবিমুখ শিক্ষকের প্রবেশ অনুচিত।
প্রশ্ন : প্রশ্ন আছে, বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সময়োপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। এ থেকে উত্তরণে করণীয় কি?
উত্তর : বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা আগের তুলনায় ভালো হলেও যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুটা ভালো হলেও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় মেধাবীরা আগ্রহ দেখায় না। গ্রামাঞ্চলে কারিগরি শিক্ষা সনদ প্রাপ্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এজন্য নিচের স্তরে সব শিক্ষা ব্যবস্থা একমুখী হওয়া উচিত।
প্রশ্ন : প্রাথমিক স্তরের পিএসসি ও মাধ্যমিক স্তরের জেএসসি পরীক্ষা আর থাকছে না বলে শোনা যাচ্ছে। এটিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
উত্তর : প্রাথমিক স্তরের পিএসসি ও মাধ্যমিক স্তরের জেএসসি পরীক্ষা বজায় রাখা সঠিক ছিল। এতে শিক্ষার্থীরা ছোট থেকেই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে অভ্যস্ত হয়। অন্যদিকে পরীক্ষা গ্রহণের ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীর সঠিক পরিসংখ্যান এবং উভয় স্তরে সরকারি মেধা বৃত্তি প্রদান সম্ভব হচ্ছে। কিছু অভিভাবক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ব্যাপারে ভীতি তৈরি করে যা কাম্য নয়।
প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ার আগ্রহ কমে গেছে বলে বিভিন্ন গবেষণা বা জরিপে দেখা গেছে। এর কারণ কি? এ থেকে উত্তরণে করণীয় কি?
উত্তর : বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ার আগ্রহ গ্রামে কমে গেলেও শহরে তুলনামূলক বেড়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞান পড়ার আগ্রহ কমে গেলেও এর পেছনে আর্থিক সমস্যা, দক্ষ বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব, বিজ্ঞান ভীতি কারণ বলে মনে করি। দারিদ্র্য দূরীকরণ, বিজ্ঞান শিক্ষকের পর্যাপ্ততা, পাঠদানে আন্তরিকতা, পর্যাপ্ত ব্যবহারিক শিক্ষার সুযোগ এবং বিশেষভাবে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করে তোলা জরুরি প্রয়োজন।
প্রশ্ন : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি চালু আছে। শিক্ষার্থীদের ইংরেজির ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে আরও সমৃদ্ধ করতেই তা করা হয়েছে। এটি কতটা সফল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি চালুর সময় উপযোগী হলেও শিক্ষার্থীরা ইংরেজির ব্যবহারিক দিক অর্থাৎ Leistening, Speaking, Reading And Writing এই চারটি দক্ষতার যথার্থ বিকাশে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। এর মূল কারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী এখনো গতানুগতিক অর্থাৎ পুরাতন পদ্ধতি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে পারেননি। অধিকন্তু, শিক্ষার্থীদের মাঝে এখনো ইংরেজিতে পরীক্ষা পাস এবং উচ্চতর গ্রেড অর্জনই মূল লক্ষ্য, দক্ষতা অর্জন নয়। তাদের ইংরেজি ভীতি দূর করতে হবে। ছোট ছোট বাক্য বলা ও তৈরি করার মাধ্যমে ইংরেজি শিখতে পারে। তাদের বুঝতে হবে ইংরেজি না জানলে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই।
প্রশ্ন : আধুনিক সময় বেশ প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। এ প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার্থীদের করণীয় কি বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : যোগ্যতম ব্যক্তিরাই সমাজে টিকে থাকবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আধুনিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এজন্য দরকার শিক্ষক ও সময় উপযোগী কারিকুলাম।
প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধসহ অন্যান্য যাবতীয় গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের করণীয় কি?
উত্তর : এক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের মানসিক মূল্যবোধ, দেশাত্মবোধ ও ক্ষমাশীলতা জাগ্রত করতে পারে। তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা, ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশীলন, সামাজিক দায়িত্ব পালনে আগ্রহী করে তুলতে হবে। মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো শিক্ষকের বড় দায়িত্ব। তাদের নিজেদের সন্তানদের মতো মনে করে শিক্ষা দিতে হবে। পিতা-মাতাকে সন্তানদের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধ শিখাতে হবে। তাদের প্রতি সজাগ থাকতে হবে। তারা যেন অসৎ সঙ্গী থেকে দূরে থাকে। তা না হলে বিপদগামী হবে। পরে আর সংশোধনের সুযোগ থাকবে না।
প্রশ্ন : গত কয়েক বছর ধরেই দেশে কর্মমুখী শিক্ষার সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
উত্তর : বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। শিক্ষা শুধু তাত্ত্বিক হলে তা জীবন জগতে ফলপ্রসূ হয় না। তবে বর্তমানে শিক্ষাক্রমে বিষয়টি সংযোজিত হলেও তা নিছক গতানুগতিকতায় পরিণত হয়েছে। অন্যান্য পাঠ্য বিষয়ের মতোই এখানে শিক্ষার্থীরা পুরনো পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে এরূপ শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে বাস্তব ও ব্যবহারিক হওয়া দরকার।
প্রশ্ন : অভিযোগ রয়েছে, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে পাসের হার বাড়লেও কর্মোপযোগী মেধাবী কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। এর জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে কী কোনো সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?
উত্তর : বিষয়টি সত্য বলে মনে করি। সচেতনতার সঙ্গে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, সর্বক্ষেত্রেই দক্ষ, যুগোপযোগী, মেধাবী কর্মীর বড়ই অভাব। এক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থায় তাত্ত্বিক শিক্ষার চেয়ে ব্যবহারিক শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা গবেষণা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
প্রশ্ন : শহরাঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনে খেলার মাঠ নেই। পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এতে মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কি পিছিয়ে পড়ছে? আপনার অভিমত কি?
উত্তর : বিষয়টি সত্য। এর ফলে শিক্ষার্থীরা সহ-পাঠ্য ক্রমিক কার্যক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে পারঠে না। এতে মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই পিছিয়ে পড়ছে। সহ-পাঠ্য ক্রমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি।