মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
ভিসির কথা

শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানই যথেষ্ট নয় প্রয়োজন প্রায়োগিক শিক্ষাও

শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানই যথেষ্ট নয় প্রয়োজন প্রায়োগিক শিক্ষাও

দেশের উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক মান নিয়ে বিতর্ক ও প্রশ্ন আছে। এর উন্নয়নের লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবি উঠছে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয় কী, শিক্ষাকে আধুনিক ও কর্মমুখী করতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের করণীয় কী এসব নিয়েই কথা বলেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের ভিসি প্রফেসর ড. একেএম নূর উন নবী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর—শাহজাদা মিয়া আজাদ

 

প্রশ্ন : দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বিতর্ক ও প্রশ্ন আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

ভিসি :  শুধু বাংলাদেশে কেন, যে কোনো দেশের শিক্ষার মান নিয়েই বিতর্ক ও প্রশ্ন রয়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তো বটেই। বিতর্কগুলো তৈরি হয় উচ্চশিক্ষার ধরন, শিক্ষকদের গুণগত মান ও ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কসহ বহু উপাদানের কারণে। উচ্চশিক্ষার নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। বিজ্ঞানমনস্ক বস্তুনিষ্ঠ জীবনমুখী মানবিক মূল্যবোধসম্মত উচ্চশিক্ষার জন্য যে পরিবেশ, সুযোগ ও সামর্থ্য থাকা দরকার তার অভাবের কারণেও প্রশ্ন তৈরি হয়। আমাদের দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন নীতিমালায় চলে না। চারটি বিশ্ববিদ্যালয় চলে ১৯৭৩ আদেশ অনুসরণে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে নীতিমালার পার্থক্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে। এসব বিষয়ে আমাদের যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।

প্রশ্ন : দেশে গুণগত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে প্রধান অন্তরায়গুলো কী কী?

ভিসি : মনে রাখতে হবে যে, উচ্চশিক্ষার সাফল্য নির্ভর করে বিভিন্ন স্তরের (প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) শিক্ষার গুণগত মানের ওপর ও ছাত্র-ছাত্রীর সুকোমল মানবিক গুণাবলি বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত হয় কিনা তার ওপর। ছাত্র-শিক্ষকের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের যান্ত্রিকতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষা, শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীর ওপর পারিবারিক, সামাজিক ও সহপাঠীদের দ্বারা যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে তা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এক ধরনের নৈতিকতা তৈরি করে, যা শুধু উচ্চ জিপিএ অর্জনকেই প্রধান লক্ষ্য করে ফেলে। শিক্ষার আদর্শ পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক লাভ-লোকসানের আদর্শে। শিক্ষকের শিক্ষাদানের প্রতি উবাড়ঃরড়হ এর অভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণভাবে দৃশ্যমান। শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনা এখন প্রধান নয়, প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে কোচিং সেন্টারের শিক্ষা। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে জড়ষব গড়ফবষ-এর অভাব রয়েছে প্রকটভাবে। শিক্ষাঙ্গনে সাংস্কৃতিক চর্চা ও খেলাধুলার সুযোগ অনেক কমে গেছে। শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী জড়িয়ে পড়েছে সংঘাতময় সম্পর্কের মধ্যে। শিক্ষার বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রতিযোগিতার মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। প্রতিদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ছে কিন্তু সেই তুলনায় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এছাড়া উচ্চশিক্ষার অভিভাবক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তরায়।

প্রশ্ন : উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী ধরনের সংস্কার আনা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

ভিসি : খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অনেক ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। প্রথমত, বহুমুখী মেধার লালনক্ষেত্র হিসেবে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন। এই একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার পরামর্শ ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে খুব স্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে। দ্বিতীয়ত প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা কারিকুলামের মধ্যে একটি স্থায়ী যোগসূত্র থাকতে হবে। তৃতীয়ত শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে শুধু স্বচ্ছ নয় প্রায়োগিকভিত্তিক হতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। চতুর্থত শিক্ষার বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, মুক্ত মনের পরিসরে বৈশ্বিক মানদণ্ডগুলো গ্রহণ করতে হবে। নৈতিকতার আদর্শবাদিতাকে লালন করতে হবে। গবেষণার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। 

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের ৬১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ‘কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স প্রকল্প’ গ্রহণ করেছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ভিসি : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক ‘কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স প্রকল্প’ বাস্তবায়ন একটি খুব সময়োপযোগী পদক্ষেপ। বৈশ্বিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে হলে একটি অভিন্ন নীতিমালার মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ ও মান নিশ্চিত করার জন্য এটি খুব প্রয়োজনীয়। তবে এর জন্য শিক্ষকবৃন্দের জন্য সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। 

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীরাও চাকরি লাভের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। বলা হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য চাহিদামাফিক যোগ্যতা নেই তাদের। এ থেকে উত্তরণের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার করণীয় কী?

ভিসি : বক্তব্যটি পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই প্রবেশ করছে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো চাকরির বাজারভিত্তিক বাস্তবকর্মমুখী শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠক্রমের চর্চা। শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। প্রায়োগিক শিক্ষা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ক্লাসরুমে বক্তৃতার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক পাঠক্রম প্রয়োজন। তবেই চাকরি বাজারে প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারবে শিক্ষার্থীরা।

প্রশ্ন : গুণগত ও মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে আপনার প্রতিষ্ঠান কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?

ভিসি : প্রতিনিয়ত পাঠক্রমের পরিমার্জন করা হচ্ছে। নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সেশনজট মুক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা সহযোগী কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিয়োজিত করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে যেমন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কর্মশালা, বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুভিত্তিক আঞ্চলিক গোলটেবিল আলোচনা, মতবিনিময় সভা, আন্তর্জাতিক সম্মেলন ইত্যাদি। এছাড়াও শিক্ষাতিরিক্ত কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্কাউটিংসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানবিক সুকোমল বৃত্তিগুলো বিকাশের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত?

ভিসি : আমার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার ৪০০ জনের মতো শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।

প্রশ্ন : আপনার শিক্ষাজীবনের কোনো মধুর স্মৃতি থাকলে বলুন।

ভিসি : শিক্ষাজীবনে সব সময় একজন ভালো ছাত্র হিসেবে বহু মধুর স্মৃতি রয়েছে। একজন রাজনীতি সচেতন ছাত্র হিসেবে দেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণসহ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় বাংলা’ নামের যে মহাকাব্য রচনা করেছেন সেই মহাকব্যের পতাকা, স্বাধীন ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব এবং ধর্মনিরপেক্ষ একটি সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মতো গর্বিত ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তবে ব্যক্তিগত মধুর স্মৃতি বলতে গেলে বর্তমানে আমার জীবন সঙ্গিনী সে সময়ের ১৬ বছর বয়সের কলেজ পড়ুয়া প্রথম বর্ষের তরুণীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটি। ‘সুইট সিক্সটিন’ কী রোমাঞ্চকর তাই না? আমার তখন উনিশ। কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েছি। কিন্তু মাঝে মধ্যেই কলেজে গিয়ে আড্ডা দিতাম। সেদিন আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরব এমন সময় আমার বন্ধু বাদামওয়ালাকে দেখে বলল ‘চল বাদাম খেতে খেতে বাড়ি যাই।’ আমি বাদামওয়ালাকে ডাকলাম। একইসঙ্গে একটি মেয়ে তার বন্ধুসহ সেই বাদামওয়ালাকেই ডাকল। আমরা এক ছটাক বাদাম চাইলাম, ওরাও এক ছটাক বাদাম চাইল। কিন্তু মজার বিষয় হলো, দিনের শেষ বলে বাদামওয়ালার কাছে এক ছটাক বাদামই ছিল। আমরা না কিনে ওদেরই বাদাম কিনতে দিলাম। বাদামের মূল্য সেই ছাত্রীটি দিলেও বাদামের ভাগ ওরা আমাদের দিয়েছিল। সেই থেকে আলাপ পরিচয়, পরে বন্ধুত্ব। কিন্তু কে জানত সেই বাদামের ভাগাভাগিটা শেষ পর্যন্ত জীবনের ভাগাভাগিতে পরিণত হবে? আমি এখনও ধন্যবাদ জানাই আমার সেই বন্ধুকে যে বাদাম খাবার প্রস্তাবটি দিয়েছিল বলে আমার জীবনে এমন একটি মধুর স্মৃতি তৈরি হয়েছিল জীবনের সব অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে।

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?

ভিসি : লেখাপড়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষা সহযোগী সব কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করে একজন দায়িত্ববান ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করতে হবে। সর্বোপরি দেশের উন্নয়নে অংশীদার হতে হবে। নিজেকেও সমাজের কাছে একটি জড়ষব গড়ফবষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষাকে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

সর্বশেষ খবর