শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
শিক্ষকের কথা

শিক্ষকতা অন্য দশটি পেশার মতো নয়

শিক্ষকতা অন্য দশটি পেশার মতো নয়

এইচএসসি ছাড়াও অনার্স  এবং মাস্টার্স প্রোগ্রাম রয়েছে দেশের এমন ৬৮৫টি কলেজের উপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো একটি র্যাংকিংস করেছে। এতে বরিশাল বিভাগের সেরা ১০টি কলেজের একটি হয়েছে সরকারি ব্রজমোহন কলেজ।  প্রতিষ্ঠানটির এই সফলতার গল্প, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়নে করণীয় কী, সহ-শিক্ষাকার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলির বিকাশে কীভাবে ভূমিকা রাখে এসব নিয়েই কথা বলেছেন কলেজটির অধ্যক্ষ প্রফেসর স ম ইমানুল হাকিম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল— রাহাত খান

 

 

প্রশ্ন : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো দেশের সব কলেজের র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

অধ্যক্ষ : বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এ র্যাংকিং প্রকাশের ফলে কলেজগুলোর মধ্যে পাঠদানসহ বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমকে ঘিরে একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি কলেজের প্রকৃত অবস্থান কি তা বোঝা যাচ্ছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকবৃন্দ এ র্যাংকিং অনুযায়ী কলেজ পছন্দ করতে পারছে। তবে র্যাংকিং নির্ধারণের সূচকগুলোকে উন্মুক্ত করে দেওয়া প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকবৃন্দ এগুলো জানতে পারে। র্যাংকিংয়ের উপযোগিতা বহুমাত্রিক। জাতীয় পর্যায়ে র্যাংকিংয়ের অবস্থান অনুযায়ী অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ, ভালো মানের শিক্ষক পদায়ন, শিক্ষক-কর্মচারীদের পদ সৃষ্টির সুযোগ দিলে র্যাংকিংয়ের প্রায়োগিক তাৎপর্য বাড়বে বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন : কলেজ র্যাংকিংয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে আপনার প্রতিষ্ঠান সেরা দশটির একটি। এই সফলতার পেছনে কোন কোন বিষয় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন?

অধ্যক্ষ : মূলত কলেজ র্যাংকিংয়ে সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ জাতীয় পর্যায়ে সেরা পাঁচটি কলেজের একটি এবং সে অর্থেই বিভাগের সেরা কলেজ। মূলত ব্রজমোহন কলেজের এ সফলতার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে এর নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম ও পরীক্ষা গ্রহণ। ব্রজমোহন কলেজ নিয়মিত নিজস্ব একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করে থাকে। প্রতিটি শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম একাডেমিক সূচি অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট কমানোর জন্য যে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে, কলেজের শিক্ষকরা তা বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমি একাডেমিক শৃঙ্খলা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। একটা একাডেমিক টিম ও ভিজিলেন্স টিম উপাধ্যক্ষের নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া সহশিক্ষা কার্যক্রমেও নিয়েছি সর্বাত্মক উদ্যোগ। কলেজের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, আইটি, শিক্ষার্থীর নৈতিক শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিস্তার ও শুদ্ধাচার চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমান্তরালভাবে উদ্যোগ নিয়েছি বলে আজ আমাদের এই অর্জন।

প্রশ্ন : দেশের শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। মান বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যক্ষ : দেখুন শিক্ষার গুণগত মানের সঙ্গে পাঠদান, পাঠ উপকরণ, পরীক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষা অবকাঠামো, কারিকুলাম, সিলেবাস, দক্ষ শিক্ষক, কর্মসংস্থানের সুযোগ, শিক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি ইত্যাদি অনেক বিষয় জড়িত। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে শিক্ষায় গুণগতমান বাড়াতে হলে সবার করণীয় কী এ প্রশ্নটির আঙ্গিকটা অনেক বিস্তৃত। তবে এ জায়গাটিতে প্রথমত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব নিতে হবে এ বিষয়ক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য। সেক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক।

প্রশ্ন : শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকরা কি ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যক্ষ : শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাই অত্যধিক ও অগ্রগণ্য। একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষকই পারেন মানসম্মত শিক্ষাদান করতে। শিক্ষকদের মাইন্ডসেটও পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষকতা পেশা অন্য দশটি পেশার মতো নয়। এটা জাতি বিনির্মাণের পেশা। জাতির বিবেক তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষকই মূল নিয়ামক। তবে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই শিক্ষকদের ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া উচ্চশিক্ষা স্তরে গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের গুরুত্ব অপরিহার্য।

প্রশ্ন : শিক্ষকদের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ থেকে উত্তরণে করণীয় কী?

অধ্যক্ষ : সামগ্রিকভাবে দেশের শিক্ষকদের মান ও মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মূলত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটা শিক্ষকদের মানকে সমর্থন করে না। আজকাল মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসছে না। শিক্ষকতা পেশায় বেতন কাঠামো, সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা, প্রশিক্ষণের স্বল্পতা, গবেষণা অবকাঠামোর অভাব, বিশেষ করে শিক্ষায় বরাদ্দের অপ্রাচুর্যতা, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষা অবকাঠামো ও উপকরণের অভাবে শিক্ষার মানটা বাড়ছে না। আমার মনে হচ্ছে, যুগান্তকারী জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’র বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি করার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার মান বাড়াতে হলে সারাদেশে শিক্ষকদের বেতন, মর্যাদা, প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়াতে হবে। এজন্য জাতীয় বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি অপরিহার্য।

 প্রশ্ন : মূল্যবোধের অবক্ষয় এখন সমাজের সর্বস্তরে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর উন্নয়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?

অধ্যক্ষ : ১৮৮৯ সালে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ব্রজমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শুধু পাঠদানের ব্রত নিয়ে নয়, এর একটা আদর্শিক প্রেক্ষাপট ছিল। শিক্ষার পাশাপাশি সত্য, প্রেম ও পবিত্রতার মহান আদর্শকে সর্বতো অর্থে ধারণ করে আছে সরকারি ব্রজমোহন কলেজ। মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, আত্মউন্নয়ন ও সামষ্টিক চেতনা, অসম্প্রদায়িক মনোভাব, মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন আধুনিক বিশ্ব নাগরিক নির্মাণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই মৌলিক ভূমিকা রাখতে পারে। এ ধারাটি বজায় রাখার প্রচেষ্টায় ব্রজমোহন কলেজ শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের বহুমাত্রিক পদক্ষেপ যেমন- ক্রীড়া, নাটক, বিতর্ক, বই পড়া, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, রক্তদান কর্মসূচি, মাদক ও জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম, আইটিভিত্তিক কর্মসূচি সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শিক্ষার্থীর মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন : সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার মান উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?

অধ্যক্ষ : সহশিক্ষা কার্যক্রম ব্যতীত একটি প্রতিষ্ঠান পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণ ও শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানের জানালা উম্মোচন করতে পারে। কিন্তু ওই জ্ঞানের সঙ্গে একজন শিক্ষার্থীর মনন ও মানসিকতার যোগসূত্র নির্মাণ করে সহশিক্ষা কার্যক্রম। মানবিক মূল্যবোধ ও স্বদেশচেতনার প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীলতা একমাত্র সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমেই বিকশিত হয়।

প্রশ্ন : আপনার শিক্ষাজীবনের কোনো মধুর স্মৃতি থাকলে বলুন।

অধ্যক্ষ : আমি সরকারি ব্রজমোহন কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্র। আমার এই প্রিয় বিদ্যাপীঠে ১৯৭৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৪তম জন্মদিবস ক্যাম্পাসে উৎসবমুখর পরিবেশে ভাবগম্ভীরতার সঙ্গে উদযাপন করি। সেসময় আমাদের নেতা ছিলেন তখনকার তুখোড় ছাত্রনেতা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ-বান্ধব সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং ছিলেন আমার বন্ধু নন্দিত ছাত্রনেতা শহিদ খান। তাদের নেতৃত্বে আমরা বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালীন সরকারি বিএম কলেজে তাঁর জন্মদিন পালন করি। এখন স্মৃতি হাতরালে মনে হয় কলেজ ক্যাম্পাসে জাতির পিতার সেসময় জন্মদিন পালনই ছিল আমার সবচেয়ে মধুর ও গৌরবময় স্মৃতি।

প্রশ্ন : স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আপনার উপদেশ কী?

অধ্যক্ষ : শুধু সনদ প্রাপ্তি নয়, একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে নির্মাণ করাই একজন শিক্ষার্থীর প্রধান ব্রত হওয়া উচিত। শিক্ষার্থী বন্ধুরা, যা কিছু শুভ, যা কিছু কল্যাণময়, যা কিছু বিজ্ঞান ও মানবিক বোধসম্পন্ন সেটাকে সবসময় হ্যাঁ বল। অশুভ, অকল্যাণকর, সংঘাত ও জঙ্গিবাদকে না বল। দেশকে ভালোবাসো। এদেশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছে। জাতির পিতার সোনার বাংলা বিনির্মাণের দায়িত্ব তোমাদের। সুতরাং নিজেকে সেভাবে গড়ে তুলতে হলে নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নাও। প্রতিদিন শরীরচর্চা করবে। দেশের ও মানুষের সেবায় আত্মোৎসর্গ কর। মনে রাখবে, তোমরা ভবিষ্যতের কারিগর।

সর্বশেষ খবর