সোমবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

অষ্টম শ্রেণি : চারু ও কারুকলা

মো. শফিকুল ইসলাম

অষ্টম শ্রেণি : চারু ও কারুকলা

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে চারুশিল্প ও শিল্পীরা

দ্বিতীয় অধ্যায় : সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

 

১. চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট বা প্রথম গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউট কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? প্রতিষ্ঠাতাদের নাম উল্লেখ করে সংক্ষিপ্ত বিবরণ লেখ।

উত্তর : ১৮৪৭ সালে দেশ ভাগের পর কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র এবং পরবর্তী সময় শিক্ষক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে তাঁর সহকর্মীরা পূর্ব পাকিস্তানে একটি ছবি আঁকা শেখার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অসহযোগিতা, ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এটি প্রতিষ্ঠা করার পেছনে শিল্পীদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ছাত্ররা শুধু ছবি আঁকা বিষয়টি হাতে-কলমে শিখবে, সে জন্য তাঁরা শিল্পী বানাবার জন্য চারুকলা শেখার প্রতিষ্ঠান করতে চাননি। তাঁরা চেয়েছিলেন এই চারুকলাকে কেন্দ্র করে ছবি আঁকা, ভাস্কর্য ও অন্যান্য শিল্পের মাধ্যমে নানা রকম সংস্কৃতি চর্চা, ভাষার চর্চা, সম্মান ইত্যাদিও প্রসারিত হবে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়বে। তাঁরা নানাভাবে সরকারকে এর প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছেন। শিল্পীদের পাশাপাশি অনেক জ্ঞানী-পণ্ডিত, শিল্পানুরাগী ব্যক্তিও এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। অবশেষে বাংলাদেশের প্রথম ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠান ‘গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৫ নভেম্বর। চারুকলার প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমদ, খাজা শফিক আহমেদ, শফিকুল আমিন, মোহাম্মদ কিবরিয়া—এঁরা সবাই চিন্তা-চেতনায় ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন। চারুকলা চর্চার প্রথম দিক থেকেই যাঁরা ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠাতা শিল্পীদের চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করেই শিল্পচর্চা করেছেন।

২. ২১-এর প্রভাতফেরিতে আলপনা ও পরবর্তী সময়ে আলপনার ব্যবহার বিষয়ে লেখ?

উত্তর : আলপনা বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ বিষয়। ১৯৫৩ সাল থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ভোরবেলা আলপনা আঁকা রাজপথে খালি পায়ে প্রভাতফেরি করে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হতো। পাকিস্তান সরকার বাধার সৃষ্টি করল। আলপনা আঁকা যাবে না। আলপনা হিন্দু ধর্মের বিষয়, মুসলমানদের জন্য আলপনা আঁকা নিষেধ ইত্যাদি। কিন্তু এসব ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালিদের সংস্কৃতি চর্চায় বাধা দেওয়া। চিত্রশিল্পীরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এসব মিথ্যা যুক্তি মানল না। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও চিত্রশিল্পীরাই বিশেষ বিশেষ রাস্তায় আলপনা আঁকতেন। চিত্রশিল্পীরাই আলপনাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন।

বর্তমানে আলপনার ব্যবহার বাঙালি সংস্কৃতির একটি অত্যাবশকীয় অনুষঙ্গ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে বা যেকোনো শুভ কাজে আলপনার ব্যবহার এখন স্বাভাবিক সংস্কৃতি। যেমন—বিজয় দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে, ঈদ উৎসবে, বিয়ের অনুষ্ঠানে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আনন্দ অনুষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আলপনার ব্যবহার সুন্দর ও শুদ্ধভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীরাই আলপনাকে বাঙালির সমাজজীবনে স্বাভাবিক সংস্কৃতিচর্চা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

৩. স্বাধীনতা ও বিপ্লবী চিত্রের মিছিল সম্পর্কে লেখ।

উত্তর : ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেল আওয়ামী লীগ। তা সত্ত্বেও তৎকালীন সামরিক সরকারপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো অযৌক্তিকভাবে বললেন, আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেবেন না। বাঙালিরা ভোটে জিতলেও বাঙালিদের হাতে পাকিস্তানের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেবেন না। ক্ষমতার অংশীদার তাঁরাও হবেন। ফলে বিক্ষোভের দাবানল জ্বলে উঠল সারা পূর্ব পাকিস্তানে। ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার অন্যায় ঘোষণা বাঙালিরা কেউই মেনে নিতে পারল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। এ দেশ পাক সরকারের নির্দেশে চলবে না। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এখন থেকে শেখ মুজিবের নির্দেশে চলবে। আর এ নিয়ম চলবে যত দিন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা না হয়।

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতাবিষয়ক ঘোষণার পর চিত্রশিল্পীরা সেই বক্তৃতার মূল বিষয়টি বুঝে ফেললেন। তাঁরা অপেক্ষা করতে রাজি নন। তাই ছবি ও পোস্টারের মাধ্যমে প্রকাশ্যেই স্বাধীনতাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিত্রশিল্পীরা সবাই এক জোট হয়ে আলোচনায় বসলেন। ছবি এঁকে, পোস্টার ও বড় বড় ব্যানার লিখে বাঙালির এই অসহযোগ আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও মুর্তজা বশীরকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হলো। ১০ দিন ধরে কয়েকশ’ ছবি ও পোস্টার এঁকে চিত্রশিল্পীরা ১৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শহীদ মিনার থেকে বিপ্লবী চিত্রের বিশাল এক অভিনব মিছিল বের করলেন। প্রত্যেক শিল্পীর হাতে একটি করে আঁকা চিত্র। আর এসব চিত্রের বিষয় হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের তথা বাঙালিদের বঞ্চনার ছবি, নির্যাতনের ছবি, বাঙালির সম্পদ লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের ছবি, বাংলার ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি আক্রমণ ও অবহেলার ছবি, সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের ছবি। মার্শাল ল-এর আইন অনুযায়ী এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এর জন্য দেখামাত্র গুলি করতে পারে। চিত্রশিল্পীরা মৃত্যু হতে পারে জেনেই এই মিছিল বের করেছেন। এই বিপ্লবী চিত্রের মিছিলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল স্বাধীনতা। এই চারটি অক্ষর বড় বড় করে সুন্দরভাবে লিখে চারটি মেয়ে গলায় ঝুলিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে হেঁটে ছিল।

এই বিপ্লবী মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সেদিন তিনিই ছিলেন শিল্পীদের সবচেয়ে বড় সাহস ও শক্তি। রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল এই চলমান প্রদর্শনী দেখার জন্য। খবর পেয়ে বেগম সুফিয়া কামাল মিছিলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পাশে থেকে শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মিছিলটি শহীদ মিনার থেকে সেগুনবাগিচার তোপখানা রোড হয়ে বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে নবাবপুর রোড ধরে ভিক্টোরিয়া পার্ক বা বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত গিয়েছিল। তবে পাকিস্তান সরকারের সেনাবাহিনী বা পুলিশ বাহিনী মিছিলে বাধা দেয়নি এবং গুলিও করেনি।

৪. চারুকলার পথযাত্রায় প্রথম এক যুগে যে কয়জন চিত্রশিল্পী চারুকলাকে বিকশিত করার জন্য অশেষ অবদান রেখেছেন তাঁদের নাম লেখ।

উত্তর : বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চায় ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত চারুকলা প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে ছবি আঁকা, ভাস্কর্য ও অন্যান্য শিল্পকর্মের মাধ্যমে নানা রকম সংস্কৃতি বিকশিত হয়, বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। এটি প্রতিষ্ঠার পেছনে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তাঁর নেতৃত্বে চারুকলার পথযাত্রায় প্রথম এক যুগে যে কয়জন চিত্রশিল্পী চারুকলাকে বিকশিত করার জন্য অশেষ অবদান রেখেছেন, তাঁরা হলেন—শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, মর্তুজা বশীর, আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল বাসেত, হামিদুর রহমান, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, নিতুন কুণ্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, আবুল বারক আলভী, মাহমুদুল হক, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।

এঁরা সবাই ছিলেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন। চারুকলা চর্চার প্রথম দিক থেকেই যাঁরা ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠাতা শিল্পীদের চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করেই শিল্পচর্চা করেছেন।

৫. পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য লেখ।

উত্তর : ব্রিটিশদের ২০০ বছর শাসনের পর ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান-ভারত নামের দুটি আলাদা দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের ছিল আবার দুটি অংশ—পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তান এবং প্রায় সর্বপূর্বে পূর্ব পাকিস্তান। দুই অঞ্চলের মাঝে দূরত্ব ছিল অনেক। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান একই দেশ হলেও একমাত্র ধর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুতেই দুই দেশের মধ্যে মিল ছিল না। ভাষা, পোশাক, খাওয়া-দাওয়া, জীবনযাপন, সংস্কৃতি—সব কিছুই ছিল ভিন্ন। এমনকি দুই অঞ্চলের জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশও ছিল ভিন্ন।

আয়তনের দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তান বড় হলেও মোট জনসংখ্যার ৫৫ ভাগ মানুষ বাস করত পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু শাসনভার পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে থাকায় পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চরম অবহেলার মধ্যে রাখা হতো। তারা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের কোনো গুরুত্ব দিত না; বরং সব ক্ষেত্রে অবহেলাই করত। বাঙালিরা উপযুক্ত ও গুণী হলেও তাদের বঞ্চিত করে চাকরির ভালো ও উচ্চ পদগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বসানো হচ্ছিল। সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সর্বত্রই পশ্চিম পাকিস্তানিদের বসিয়ে মর্যাদা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর শোষণ, আধিপত্য বিস্তারের ব্যবস্থা চলতে থাকে। বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার চেষ্টা করে নানাভাবে। বাংলা গান, রবীন্দ্রসংগীত এবং বাঙালির অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ওপর বিধি-নিষেধ শুধু নয়, অনেক সময় শাসকগোষ্ঠীর পেটোয়া বাহিনী অত্যাচার চালায় সাধারণ মানুষের ওপর। পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা। ৯৯ ভাগ মানুষই বাংলায় কথা বলে। মাত্র ১৫ ভাগ মানুষ কথা বলে উর্দু ভাষায়।

সর্বশেষ খবর