সোমবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

এসএসসি পরীক্ষা প্রস্তুতি

বাংলা দ্বিতীয়পত্র

সুকুমার মণ্ডল

এসএসসি পরীক্ষা প্রস্তুতি

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির লিখে রেখ এক ফোঁটা দিলেম শিশির।

 

ভাবসম্প্রসারণ : যারা সংকীর্ণ হৃদয়ের অধিকারী, তারাই নামেমাত্র উপকারের জন্য আত্মগৌরব অনুভব করতে চায় এবং তুচ্ছ উপকারের দৃষ্টান্ত ফলাও করে প্রকাশে প্রয়াসী হয়। নিজের সামান্য অবদানে বাহাদুরি করার চেয়ে পরের নিঃস্বার্থ উপকারে প্রশংসা যে করা উচিত, তা এক শ্রেণির কৃতজ্ঞতাহীন ব্যক্তি সহজেই ভুলে যায়।

শৈবালের জন্ম ও জীবন দিঘির বুকে—দিঘির পানিতেই তার অস্তিত্ব ও স্থিতি। শৈবাল তার অস্তিত্বের জন্য পুরোটাই দিঘির ওপর নির্ভরশীল। এমনি পরাশ্রয়ী, পরাবলম্বী, পরমুখাপেক্ষী শৈবালের ওপর শীতের রাতের কল্যাণে জন্মেছিল কয়েক ফোঁটা শিশির এবং বাতাসের বদৌলতে তা গড়িয়ে পড়েছিল দিঘির অথৈই পানির বুকে। এতেই শৈবালের অহংকারের অন্ত নেই। গর্বের সীমা নেই, শৈবাল তার এক বিন্দু শিশিরের কথা আড়ম্বরে স্মরণ করিয়ে দেয় দিঘিকে। বিরাট দিঘির অগাধ পানিতে এক ফোঁটা শিশিরপাত অতি তুচ্ছ ঘটনা। অথচ দিঘির কাছে শৈবালের ঋণের কোনো হিসাব নেই। শৈবালের একটুও মনে পড়ে না কে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া এক ফোঁটা শিশির যে দিঘির কোনো কাজেই লাগে না সে কথা মূর্খ শৈবাল অহমিকার কারণে অনুধাবন করতে পারে না। শৈবালের মতো সংকীর্ণ চরিত্রের মানুষ আমরা আমাদের সমাজে সচরাচর দেখতে পাই, যারা পরাশ্রয়ে লালিত-পালিত হয়ে অন্যের সহযোগিতায় সুদিনের পথ চিনে একসময় সেই পরম আশ্রয়দাতাকেই ভুলে যায়। সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধ তার হৃদয়ে উদয় না হয়ে তার মনে জাগে একরাশ দম্ভ। এতে আশ্রয়দাতার গৌরবে কোনো ভাটা পড়ে না, তবে সংকীর্ণ মানসিকতার ব্যক্তিটির চরিত্র সহজেই উন্মোচিত হয়। অন্যদিকে এ পৃথিবীতে যাঁরা মহানুভব, সদাশয় ব্যক্তি, তাঁদের নীরব দানে পৃথিবীর নিঃস্ব অভাবগ্রস্ত নিত্য উপকৃত হয়, জীবন পায়। সর্বত্যাগী সেই মহামানবরা তাঁদের জীবন তিলে তিলে দান করে বিপন্নকে করেন উদ্ধার এবং মানবতার সেবায় রাখেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেই দানে থাকে না কোনো অহংকার, থাকে না আত্মপ্রচারের বড়াই, থাকে না বিনিময়ে উপকার লাভের কোনো প্রত্যাশা। তাঁরা দান করেন মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাঁরা হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে সুন্দর ও কল্যাণের প্রদীপ জ্বালায়, স্বীয় সৌরভে সুরভিত করেন বিশ্বজগৎ। সেই মহান উদারচেতা ব্যক্তিদের নীরব দানের বিনিময়ে সামান্য উপকার করে কোনো কোনো ক্ষুদ্রচেতা উপকৃত ব্যক্তি অহংকারী হয়ে ওঠে। তারা নিজেকে সমাজের কাছে হাস্যকর জীব হিসেবেই প্রতিপন্ন করে। অকৃতজ্ঞ, গলাবাজ, সংকীর্ণমনা এসব ব্যক্তিকে সমাজ ঘৃণার চোখেই দেখে।

রূপকের মধ্য দিয়ে উপর্যুক্ত দুটি লাইনে আমাদের মানবসমাজের বিশেষ দুই শ্রেণির লোকের চরিত্র বিশ্লেষিত হয়েছে। তাদের মধ্যে শৈবাল শ্রেণিদের সব সময়ই বর্জন করা উচিত এবং দিঘির মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষদের খুঁজে বের করে তাঁদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সমাজের কল্যাণে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করা উচিত।

 

কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে?

 

ভাবসম্প্রসারণ : সত্য সুন্দরকে লাভ করার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। সুখের জন্য মানুষের চেষ্টাও নিরন্তর। কিন্তু দুর্লভ এসব বস্তুকে সব সময়ই ঘিরে থাকে অসংখ্য বাধাবিপত্তি। সেগুলো জয় করতে পারলেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।

সুন্দর মাত্রই মানুষকে আকৃষ্ট করে। পদ্মের অপরূপ সৌন্দর্য, রং, সুগন্ধ স্বভাবতই সবাইকে আকর্ষণ করে। কিন্তু পদ্মফুল তোলার জন্য কেউ যদি হাত বাড়ায়, তবে তার হাতে কাঁটা বিঁধবেই—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ভয়ে কেউ যদি কমল তুলতে না যায়, তবে তার দ্বারা পদ্মের সৌন্দর্য উপভোগ কখনো সম্ভব নয়। সুখ, সার্থকতার স্পর্শ চায় না—এমন ব্যক্তি সমাজে বিরল। কিন্তু তা লাভ করার পথ কখনো সহজ নয়। আকাঙ্ক্ষিত পদ্মের মৃণাল যেমন কণ্টকাকীর্ণ, পৃথিবীর যাবতীয় সুখ-সাফল্যও তেমনি দুঃখ ও বাধাবিপত্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই জীবনকে সফল ও সমৃদ্ধ করতে হলে যাবতীয় দুঃখের জ্বালা সহ্য করে এগিয়ে যেতে হয়, এ জন্য প্রয়োজন হয় অধ্যবসায় ও ধৈর্যের। পৃথিবীর সব মহৎ কর্মের পেছনেই রয়েছে বহু শ্রমলব্ধ সাধনা। আজকের পৃথিবী যে সুখ-সাগরের মধ্যে ভাসছে তাও এসেছে অসংখ্য মানুষের শ্রম ও নিরলস সাধনার মধ্য দিয়ে। একের পর এক বাধা অতিক্রম করে ইতিহাসের বীর এবং মহৎ ব্যক্তিরা সংগ্রাম ও একনিষ্ঠ চেষ্টার মাধ্যমে দেশ, জাতি ও পৃথিবীর মানুষের জন্য কল্যাণের পথ তৈরি করেছেন। মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টার কাছে হার মেনেছে সভ্যতার বড় বড় বাধা। পৃথিবীর সব সুখ তাই অসংখ্য দুঃখের দ্বারা, জঞ্জালের দ্বারা আবৃত। সেগুলোকে স্বীকার করে নিয়েই পৃথিবীতে সুখ লাভের চেষ্টা করতে হয়। মানুষের গৌরব ও সম্মান নিহিত রয়েছে বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে সফলতা অর্জনের মধ্যে। একজন শিক্ষার্থীর ভালো ফল নিশ্চিত করতে হলে তাকে অবশ্যই নিষ্ঠার সঙ্গে অধ্যবসায়ী হতে হবে, তবেই আসবে সত্যিকারের সাফল্য। তা ছাড়া এ সত্যটিও এখন সর্বজনবিদিত যে শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যেই প্রকৃত গৌরব নিহিত। অন্যদিকে বিনাশ্রমে পরের দয়ার দান গ্রহণে মানুষের অমর্যাদাই বাড়ে। সাফল্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাই প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধের আহ্বান। এ যুদ্ধ চলে প্রতিনিয়ত ও প্রতিটি ক্ষেত্রে। এটাকে উপেক্ষা করে সাফল্যের কোনো সম্ভাবনাই নেই।

মানবজীবন সংগ্রামময়। সংগ্রামের মাধ্যমে দুঃখকে জয় করে, বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যেতে হবে। তবেই সৌন্দর্যকে লাভ করা যাবে, ধরা দেবে ধরণীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য।

 

গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন

নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।

ভাবসম্প্রসারণ : মানবজীবনের অত্যাবশ্যকীয় দুটি উপকরণ বিদ্যা ও সম্পদ। জীবনে চলার পথে এর গুরুত্ব অপরিসীম। যে বিদ্যা আত্মস্থ নয় এবং যে ধন অপরের কাছে সঞ্চিত, তা প্রয়োজনে কোনো কাজেই আসে না। এ ক্ষেত্রে ধন ও বিদ্যা কোনোটিই আমাদের সত্যিকারের সম্পদ বলে বিবেচ্য নয়।

পৃথিবীর ইতিহাস এখন অনেক পুরনো। জীবনযাত্রাও এখন অনেক জটিল। এ জীবন চলার পথে জ্ঞান আহরণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ এই ক্ষুদ্র জীবনে বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সব জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদের গ্রন্থের সাহায্য নিতেই হবে। গ্রন্থের তথ্য অধ্যয়ন করে বাস্তবতার নিরিখে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাস্তবজীবনে যখন কাজে লাগানো হয়, তখনই সেটি প্রকৃত বিদ্যা বা জ্ঞান হয়ে ওঠে। সেই জ্ঞানই সত্যিকারার্থে আমাদের আলোর পথ দেখায়। গ্রন্থে মানুষের চিন্তা-চেতনা, অভিজ্ঞতা, দর্শন প্রভৃতি লিপিবদ্ধ থাকে। গ্রন্থে আবদ্ধ মানব উত্কর্ষের সোনালি সাফল্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হলে বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। বুঝতে হবে তার ভাষ্য, গভীরতা, মর্মার্থ। প্রচুর বই সংগ্রহ করা এবং তাকে হুবহু গলাধঃকরণ করে সেগুলো থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। অধীত বিদ্যা যদি বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করা না যায়, জীবনের উন্নতিতে যদি তা কাজে লাগানো না যায়, তবে সে বিদ্যা কখনো সার্থকতার মুখ দেখে না। এ বিদ্যা হয়তো পরীক্ষা পাস কিংবা ভালো ফলাফলে সহায়ক; কিন্তু জীবন চলার পথে তা সহায়তা করে না। নিছক লোক দেখানো ডিগ্রি অর্জনের জন্য গ্রন্থের শরণাপন্ন হলে যথার্থ জ্ঞান অর্জন করা যায় না। প্রয়োজনের সময় সেসব জ্ঞান যথার্থ অর্থে প্রয়োগ করা যায় না। তেমনিভাবে ধনসম্পদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। বর্তমান সভ্যতার উত্কর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অর্থের কোনো বিকল্প নেই। ধনসম্পদের সদ্ব্যবহার বিশ্বে বয়ে আনে নব নব কল্যাণবার্তা, উন্নয়নের প্রাণচাঞ্চল্যকর খবর। কিন্তু এসব কোনো কাজেই যদি সম্পদের ব্যবহার করা না যায়, তা যদি শুধু নাগালের বাইরেই থাকে, থাকে অন্যত্র স্তূপীকৃত কিংবা পরের হাতে গচ্ছিত, প্রয়োজনে যদি তা নিজের অধিকারে না থাকল, তবে সে ধন থাকা না-থাকা সমান কথা। কারণ পুঁথিতে যে বিদ্যা থাকে আর পরের হাতে যে ধন থাকে দুটিই সমান। দরকারের সময় সে বিদ্যা বিদ্যা নয়। সে ধন ধন নয়। যে বিদ্যা হৃদয়ঙ্গম করা থাকে সে জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞান। আর যে ধন দিয়ে জরুরি মুহূর্তে প্রয়োজন মেটানো সম্ভব, সেটাই সার্থক ধন।

সর্বশেষ খবর