বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নকল সন্ত্রাসে নাকাল চলচ্চিত্র

আলাউদ্দীন মাজিদ

নকল সন্ত্রাসে নাকাল চলচ্চিত্র

নির্মাতারা এখন প্রায়ই বলেন ‘একটি সুস্থধারার পরিচ্ছন্ন ছবি নির্মাণ করেছি, একেবারেই মৌলিক গল্প। দর্শকের কাছে অনুরোধ, আপনারা সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখুন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচান। কথা দিচ্ছি, আগামীতে আরও ভালো ছবি উপহার দেব আপনাদের’।

নির্মাতার এমন কথায় আস্থা রেখে একটি ভালো ছবি দেখার আশায় বুক বেঁধে সিনেমা হলে যান দর্শক। আর দেখতে গিয়ে চরম হতাশা ও বিরক্তি নিয়ে বের হন। কারণ ছবিটি ভারতীয় বা অন্য দেশের ছবির নকল হয়ে থাকে সাধারণত। চলতি সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছে ‘আজব প্রেম’ ছবিটি। এই ছবি দেখে দর্শক আবারও অবাক। ছবিটি তামিল ‘আরিয়া টু’ ছবির হুবহু নকল।

দর্শকের কথায় এখন নকলের বিষয়টি এতটাই প্রকাশ্য হয়ে গেছে যে, তা দিন-দুপুরে ডাকাতি মনে হয়। এক-দেড় দশক আগে হিন্দি ছবি  থেকে টুকলিফাই ুকরা হতো। আর এখন তামিল, তেলেগু, মারাঠি, কোরিয়ানসহ বিভিন্ন ছবি থেকে হুবহু নকল করা হচ্ছে। তামিল,  তেলেগু, মারাঠি ছবি নকল করতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে সুইপার কলোনির। হিন্দি ভাষা অনেকের অনেকটা আয়ত্তে থাকলেও এই তিন ভাষার অনুবাদ এখনো সহজসাধ্য নয়। তাই অনুবাদের জন্য নির্মাতারা মাদ্রাজি সুইপারদের দ্বারস্থ হচ্ছেন।

চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে বছরের প্রায় ৯০ ভাগ ছবি নকলের অভিযোগে অভিযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া ছবির একটি  চিত্র তুলে ধরা হলোÑ ‘দাবাং’ [২০০৭-এর তেলেগু ডন মুভিসহ একাধিক ছবির সংমিশ্রণ],  ‘অগ্নি’ [২০১১-এর আমেরিকান মুভি কলোম্বিয়ানার আদলে নির্মিত], ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’  [১৯৫৪-এর আমেরিকান মুভি ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’র নকল], ‘রাজত্ব’ [২০০৬-এর তেলেগু ছবি ‘গাজাপাক্কিরি’ থেকে নেওয়া], ‘ডেয়ারিং লাভার’ [২০০৬ সালের তামিল ‘থিরভিলাইয়াডাল আরামবাম’ ও কলকাতার ‘ইডিয়ট’ ছবির নকল], ‘মায়ের মমতা’ [স্টার জলসা চ্যানেলের সিরিয়াল ‘মা’র নকল], ‘জান’ [২০০৪ সালের তেলেগু ছবি ‘মাস’র নারী সংস্করণ], ‘ভালোবাসা এক্সপ্রেস’ [২০০৩ সালের তেলেগু ছবি ‘শিবামনি’ ও ২০১৩ সালের তেলেগু ছবি ‘মিরচি’র সংমিশ্রণ],  ‘আই ডোন্ট কেয়ার’ [২০১২ সালের তেলেগু ছবি ‘রেবেল’সহ একাধিক ছবি হতে ইন্সপায়ার্ড], ‘হানিমুন’ [২০১২ সালের তেলেগু ছবি ‘রাচা’সহ একাধিক ছবির নকল], ‘অদৃশ্য শত্র“’ [১৯৯৩ সালের হিন্দি ছবি ‘বাজিগর’ ও ২০০৮ সারের হিন্দি ‘কিডন্যাপ’ থেকে ইন্সপায়ার্ড], ‘অল্প অল্প প্রেমের গল্প’ [২০১১ সালের তেলেগু ‘আলা মোদালাইন্দি’র হুবহু নকল], ‘লাভ স্টেশন’ [২০১২ সালের তেলেগু ‘ইশক’র হুবহু নকল], ‘হিটম্যান’ [২০১২ সালের তামিল ছবি ‘ভেট্টাই’র হুবহু নকল], ‘কঠিন প্রতিশোধ’ [২০১৩ সালের তেলেগু ‘মিরচি’র নকল], ‘কিস্তিমাত’ [২০১২ সালের  তেলেগু ‘গাব্বার সিং’ হতে ইন্সপায়ার্ড], ‘জানে না এ মন’ [২০০৬ সালের হিন্দি ‘গ্যাংস্টার’ থেকে সামান্য ইন্সপায়ার্ড], ‘স্বপ্ন যে তুই’ [২০০৮ সালের হিন্দি ‘জানে তু ইয়া জানে না’ থেকে ইন্সপায়ার্ড], ‘প্রেম করব তোমার সাথে [ ১৯৯৪ সালের হিন্দি ‘দিলিওয়ালে’ এবং ২০১৩ সালের তেলেগু ছবি ‘নায়াক’র নকল]। এত গেল গত বছরের চিত্র। পোড়ামন, প্রেম প্রেম পাগলামী, ফাঁদ নিয়েও নকলের অভিযোগ রয়েছে। ‘ভালোবাসা এক্সপ্রেস’ ছবিটি নকল করা হয়েছে ২০১২ সালের তেলেগু ছবি ‘রেড দ্য কালার অব লাভ’ থেকে। এ ছবিটি হিন্দিতে ‘ডেঞ্জারাস খিলাড়ি’, মালায়াম ‘গাজাপাক্কিরি’ ও তামিল ভাষায় ‘সাহাসাস’ নামে আগেই নির্মাণ হয়েছে। ‘জান কোরবান’ নকল করা হয়েছে কলকাতার ‘আই লাভ ইউ’ থেকে। চলতি বছরের মাত্র কয়েকটি ছবির উদাহরণ দিলে নকলের ভয়াবহতা আরও পরিষ্কার হবে। কোরবানির ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘রাজাবাবু’ ছবিটি তামিল ‘ধাম্মু’ এবং ‘আশিকি’ তামিল ‘ইশক’ ছবির নকল। আর ঈদের আগে মুক্তি পাওয়া ‘ব্ল্যাকমেইল’ হিন্দি ‘গুণ্ডে’ ছবির নকল ছিল।

গত দুই বছরের কয়েকটি নকল ছবির তালিকা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, নকলের দৌরাÍ্যে ঢালিউডের অবস্থা কতটা ভয়াবহ। বর্তমানে নকল হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। গল্প, গান, শট টু শট, কস্টিউম থেকে শুরু করে পোস্টার। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, বর্তমানে যে হারে বিদেশি ছবির নকল চলছে তাতে অনেক আগেই সিনেমা হল দর্শকশূন্য হয়েছে এবং সিংহভাগ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

প্রখ্যাত অভিনেতা ফারুক বলেন, ‘যাদের মেধা নেই, তারাই এমন গর্হিত কাজ করে। কতিপয় অসাধু লোক পরিশ্রম না করে রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হতে চায়। এরা নকলের আশ্রয় নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রের বারোটা বাজাচ্ছে। আমি বলি আপনারা কী দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছেন? আসলে এ অবস্থার জন্য সেন্সর বোর্ড দায়ী। নকল চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সেন্সর বোর্ডের প্রয়োজন কী?’ এদিকে সেন্সর বোর্ডের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা নকল সম্পর্কে তথ্য দিতে বলেন। অথচ তথ্য দিলেও পরে আপিল করে ছবিটি ছাড় পেয়ে যায়। এরকম অনেক ছবির মধ্যে একটি হল গত বছরের ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘হিটম্যান’ ছবিটি। দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে সচেতন দর্শক এবং চলচ্চিত্রকর্মীরা দ্রুত নকলমুক্ত চলচ্চিত্র নির্মাণের জোর দাবি জানিয়েছেন। আর এ জন্য সেন্সর বোর্ডকে যথাযথ দায়িত্ব পালনের আহবান তাদের।

সর্বশেষ খবর