শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গীতিকবিতায় মান নেই

আলাউদ্দীন মাজিদ

গীতিকবিতায় মান নেই

গান অনেক হচ্ছে। কানেও ভেসে আসছে। কিন্তু হৃদয়ে ছবি আঁকছে না। গীতিকবিতা যেন তার ঐতিহ্য হারিয়েছে। গান ও গীতিকবিতার দুর্দিনের নেপথ্য কারণ খুঁজতে আমরা মুখোমুখি হয় গীতিকবি ও সংগীতশিল্পীদের। তাদের বলা কথা তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

গানের কথায় জীবনবোধের অভাব : আমজাদ হোসেন

বর্তমানে গানের মৌলিকত্ব দুঃখজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাই এখনকার গান আর শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পারছে না। এর অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যোগ্য গীতিকার ও সুরকারের অভাব। গানের কথা ও সুরে এখন মেলোডি এবং জীবনবোধের অভাব, গভীরতা নেই। এ অবস্থায় শ্রোতারা এসব গান গ্রহণ করবে কেন? এখন তো সানাই, সেতার, বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়ামসহ কোনো অ্যাকোয়িস্টিক ব্যবহার করা হয় না। এখন সবই কি বোর্ড নির্ভর হয়ে পড়েছে। এখন যে কেউ ইচ্ছা করলেই গান লিখে ফেলতে পারছে। ভেবে দেখে না তাতে ব্যাকরণের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কি-না। মানে গান লেখা, সুর করা এবং কণ্ঠ দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। চাইলেই যে কেউ করতে পারছে। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছু সহজলভ্য হয়ে গেলে তার মান আর থাকে না।

গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য কাব্যময়তা : কে জি মোস্তফা

গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাব্যময়তা ও মেলোডি। এখন তা কোথায়? আগে তো গান লিখতে রীতিমতো পড়ালেখা করতে হতো। যারা সাহিত্যচর্চা করত তারাই গান, গল্প লিখত। এখন ইচ্ছা করলেই যে কেউ গীতিকার-গল্পকার হয়ে যেতে পারছে। বিষয়টি যেন একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে এখন সাহিত্য নির্ভরতাকে বাদ দিয়ে বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ফলে যা হওয়ার স্বাভাবিক তাই হচ্ছে। আগে গানের কথায় জীবনের ছায়া খুঁজে পাওয়া যেত। এখন তো গান মানে ফান। শুধুই মজা করার জন্য গান তৈরি হয়। উচ্চালয়ে যন্ত্র বাজতে থাকে। কিন্তু গানের কথা আর বোধগম্য হয় না। তাই শুরুতেই শেষ হয়ে যায় এসব গান। এখন গানের ক্ষেত্রে যন্ত্রই প্রধান যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে গানের কথা থেকে শিক্ষা নেওয়া হতো। এখনকার গানে মেলোডি, কাব্যময়তা, জীবনবোধ, শিক্ষা এবং গভীরতা বলতে কিছুই নেই। গান লেখা এবং করা বর্তমানে এতটাই সহজ হয়ে গেছে যে, সহজে তা হারিয়েও যাচ্ছে।

সংগীতশিল্প ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে : গাজী মাজহারুল আনোয়ার

এখন গানের লিরিকের মধ্যে প্রাণ নেই এ কথাটা সত্য। আসলে কবিতা একটি শিল্প। এতে সুর আর কণ্ঠ দিলে গান হয়। কিন্তু তথাকথিত আধুনিকতার জোয়ারে গানের কথা বা কবিতা চাপা পড়ে যাচ্ছে। এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। এটি খারাপ নয়। কিন্তু যন্ত্রের মতো গানকে যান্ত্রিক করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সীমা অতিক্রম করতে গিয়ে এখন গানে আর প্রাণের ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের সমৃদ্ধ সংগীতশিল্প এখন তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে। পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ আর অনুকরণের আগ্রাসনে মৌলিকত্ব হারাচ্ছে। এখন লেখা, সুর দেওয়া আর গাওয়া যার যার মতো করে চলছে। তাই গানের স্থায়িত্ব বা মান বলে কিছুই থাকছে না।

জীবনবোধ লালন করতে হয় : শহীদুল্লাহ ফরায়েজী

পরিবর্তনশীল রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার কারণে সংগীতের পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু ঐতিহ্য হারাতে পারে না। এই ঐতিহ্য নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। কারণ, সংগীতেই সংগীতের প্রাণ আর ঐতিহ্য নিহিত। স্টাইলে পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু নিত্যনতুন হৃদয় অনুসন্ধান করে অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য আবিষ্কার করাই মানুষের ধর্ম। এই পরিবর্তনে হতাশার কিছু নেই। জীবনবোধকে ভিতরে লালন করতে হয়। জীবনের প্রাচুর্য এবং মহামান্বিত দিককে অনুসন্ধান করতে হয়। সত্যের কাছে অবস্থান করলে গানের মাঝে প্রাণের ছোঁয়া আসবে। যে গানে জীবনের নৈতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে না, পরম সুন্দরের দিকে ধাবিত হওয়ার শক্তি দেয় না, আাত্নিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার ক্ষমতা দেয় না সেই গান অবশ্যই হারিয়ে যাবে।

পড়াশোনার বিকল্প নেই : মুনশী ওয়াদুদ

এক সময় সংগীতের যে চেহারা আমরা দেখেছি তা এখন আর নেই। তখন গান লেখা, সুর দেওয়া আর কণ্ঠে যে ভালোবাসা আর আবেগ ছিল তা এখন কোথায়? এখন যন্ত্রের দাপটে গান আর হৃদয় ছুঁতে পারে না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এখনকার গানে কাব্যময়তা, ছন্দ, অন্তঃমিলসহ আনুষঙ্গিক কিছুই নেই। অন্যদিকে গান করতে গেলে পড়াশোনার বিকল্প নেই, তবে পুঁথিগত বিদ্যা নয়। আক্ষরিক অর্থে গানকে অন্তরে ধারণ করতে হবে। এখন এসব নেই বলেই আগের গান শুনলে এখনো নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই আর এখনকার গানে বিরক্তি আসে।

এখন কেউ দীক্ষা নেয় না : খুরশীদ আলম

গান হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সাধনার বিষয়। এখন গুরুর কাছেও কেউ দীক্ষা নেয় না। সাধনাও করে না। তাই গান প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। আগে একটি গান তুলতে কয়েক মাসও সময় লেগে যেত। কথা, সুর, গায়কী নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতো। আর এখন মুহূর্তে লেখা থেকে শুরু করে এক বসাতেই গেয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই এসব গান আর প্রাণ ছুঁতে পারছে না। মানে আতুর ঘরেই মৃত্যু হচ্ছে। এখন ভালো গান হচ্ছে, তবে পরিমাণ নিতান্তই স্বল্প। এই স্বল্পতা দিয়ে এ দেশের ঐতিহ্য হিসেবে সংগীতকে ধরে রাখা যাবে না। এক সময় চলচ্চিত্রে গল্পের প্রয়োজনে গান হতো। আর এখন গানের প্রয়োজনে চলচ্চিত্র হয়। এ অবস্থার জন্যই চলচ্চিত্রের গানের অবস্থা নাকাল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণে গুরুর দীক্ষা আর সাধনা জরুরি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর