শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাজ কাহিনী

আলাউদ্দীন মাজিদ

রাজ কাহিনী

বলিউডে অশোক কুমার আর টালিগঞ্জে উত্তম কুমার একটি সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র জগৎ রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাই হয়তো তাদের আত্মা শান্তিতে আছে। কিন্তু আমরা কি রেখে যাচ্ছি? এই প্রশ্ন নায়করাজ রাজ্জাকের। অনবরত ধুলো-ময়লার আস্তরণে ঢেকে যাওয়া দেশীয় চলচ্চিত্র দুনিয়ার বর্তমান অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন এখন সোনালি দিনের এই চিরসবুজ অভিনেতা আর চলচ্চিত্রের অভিভাবকের। বৃহস্পতিবারের শেষ বিকালে মহারাজের মুখোমুখি হয়েছিলাম বাংলাদেশ প্রতিদিন পরিবারের পক্ষ থেকে। চিরাচরিত রাজকীয় ভঙ্গিতে রাজা তার আসনে উপবিষ্ট হলেন। স্মৃতির ঝুলিতে নবডঙ্কা বাজিয়ে রাজা নিয়ে গেলেন মায়াময় এক স্বর্ণালি সন্ধ্যায়। সন্ধ্যাকাশে তখন একটি তারা জ্বলজ্বল করছিল। এটি শুকতারা। মানে আমাদের মহারাজা স্বয়ং। গর্বে মেতেছে লক্ষীকুঞ্জ। দরজা ঠেলে দাদুর কোলে ছুটে এলো আদরের নাতনি আরিবা। সম্রাটের ছোট মেয়ে। বয়স আর কত। বড়জোর দেড় বছর হবে। নাতনিকে কোলে নিয়ে আনন্দে উচ্ছ¡সিত হয়ে উঠলেন নায়করাজ। বললেন, জানো ও আমার দ্বিতীয় বউ তার কথায় মুহূর্তের জন্য কপালে চিন্তার ভাঁজ টেনে পরক্ষণে হো...হো... করে হেসে উঠল সবাই। স্বভাবসুলভ হাসিতে সঙ্গী হলেন জীবন্ত কিংবদন্তি এই অভিনেতা। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরিবা যেখানে যায় বলে ও নাকি আমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। ও নাকি আমার দুই নম্বর বউ’। আবার হাসি... হাসছেন লক্ষীভাবি, সম্রাট, নির্মাতা ছটকু আহমেদ আর আমার পরিবার। এই হাসি বড় তৃপ্তির। নায়করাজের সুপারহিট ছবি বাবা কেন চাকর’ ছবিতে তারই মুখে একটি গান আছে আমার মত এত সুখী নয়তো কারও জীবন...। সত্যিই পারিবারিকভাবে খুবই সুখী একজন মানুষ নায়করাজ। গর্ব করে নিজেই এ কথা বলেন তিনি। বড়ই সত্য কথা। কিন্তু চলচ্চিত্র নিয়ে আজ তার চিন্তার শেষ নেই। এই চিন্তার কারণ অবশ্যই সঙ্গত। হাসি মুখটা যেন আবার মেঘে ঢেকে গেল তার। হতাশা নিয়ে বললেন, সেই ১৯৬৪ সাল থেকে কত যুদ্ধ করে আমাদের বাংলা ছবির জগৎকে টেনে সমৃদ্ধির আসনে বসিয়েছিলাম। একশতেরও কম সিনেমা হল বেড়ে নব্বই দশকে এসে দাঁড়াল প্রায় তেরশ’তে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য আমাদের, নানা অবক্ষয় ক্রমেই গ্রাস করতে শুরু করল এ দেশের স্বপ্নের চিত্রজগৎকে। এক সময় অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ল ঢালিউড। সিনিয়রদের আর কেউ মানতে চায় না। যার যা খুশি করতে শুরু করল। মানসম্মত নির্মাতা, গল্প, গান, শিল্পী, সিনেমা হল এক কথায় কিছুই আর নেই। ভালো ছবির অভাবে সিনেমা হল থেকে ছিটকে পড়ল দর্শক। তেরশতের জায়গায় এখন সিনেমা হল আছে তিন শতের মতো। চলচ্চিত্র ব্যবসা বলে আর কিছুই নেই। সিনেমা হল থেকে নির্মাতা এখন আর শেয়ার পায় না। উল্টো ছবি চালাতে গেলে নির্মাতাকেই সিনেমা হলের মেশিন ভাড়া গুনতে হয়। যা পৃথিবীর কোথাও নেই। এভাবে এই ব্যবসা টিকবে কি করে। দুঃখগাথা কথা বলতে বলতে এক সময় নায়ক রাজের কণ্ঠ ভারি হয়ে ওঠে। চোখের কোণে হারানোর অশ্র“ চিকচিক করে ওঠে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। বেশকিছু দিন ধরে মহানায়কের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তাই অভিনয় বা নির্মাণ থেকেও দূরে তিনি। নিজের শরীরের অবস্থা জানাতে গিয়ে নায়করাজ বলেন, সবার দোয়া আর আল্লাহতায়ালার অপার কৃপায় বেঁচে আছি। গত জুনে ১৫ দিন হাসপাতালে ভ্যান্টিলেশনে [লাইফ সাপোর্ট] ছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরল এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কাউকে ঠিকমতো চিনতে পারছিলাম না। ডাক্তারের পরামর্শে এখন বিশ্রামে আছি। লক্ষীভাবি মানে নায়করাজের প্রিয়তমা পত্নী বলেন, এখনো ভালো করে কিছু খেতে পারে না ও। মুখে রুচি নেই। হাইডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার কারণেই নাকি এই অবস্থা।  হাসপাতালে থাকতে ও খুব করে ইলিশ মাছ খেতে চাইত। কিছুটা ভালো হয়ে বাসায় ফিরলে আমি নিজেই দুটো ইলিশ মাছ কিনে আনি। ভেজে দেই। খুশিতে প্রথম দিন মজা করে খেল। পরের দিন বলল স্বাদ পাচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে এখনো খুব সমস্যা হচ্ছে তার। লক্ষী ভাবির চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ। তার মনের অবস্থা সহজেই পরিমাপ করতে পারেন নায়করাজ। তাই তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ও কিছু নয় আমি এখন পারফেক্ট অলরাইট। আবার স্বপ্নের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় ফিরে গেলেন মহারাজা। বললেন, আমাদের এখানে জুনিয়ররা সিনিয়রদের এবং প্রকৃত শিল্পীকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয় না। ফলে চলচ্চিত্র জগতের সম্মানই এখন ডুবতে বসেছে। অথচ কলকাতার কথাই বলি। আমি ওখানে যখনই কাজ করতে গেছি প্রসেনজিৎ থেকে শুরু করে সৌমিত্রবাবু পর্যন্ত আমাকে কী পরিমাণে সম্মান দেখান তা বলে বোঝাতে পারব না। আর এখানে সিনিয়রদের দেখলেও জুনিয়ররা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চায় না। এটি চরম অবক্ষয় নয়তো কী? বর্তমানে যৌথ প্রযোজনার নির্মাণকে দুঃখভরেস্মাগল  বলে আখ্যায়িত করেন তিনি। তার কথায় একদিকে এসব ছবি কলকাতায় চলছে না অন্যদিকে আমাদের নির্মাতা শিল্পী কলাকুশলির নামও কলকাতায় যৌথ-প্রযোজনার ছবির ক্ষেত্রে দেখানো হয় না। তাই যৌথ প্রযোজনার এ ধরনের নির্মাণ আর বেশিদিন চলবে বলে মনে হয় না। বড় কষ্ট নিয়ে বড় করে শ্বাস নেন নায়ক রাজ। তারপর বলেন, এ দেশের চলচ্চিত্রের আর কিছু হবে বলে মনে হয় না। নতুন ভোরের আলো দেখতে পাচ্ছি না। অপলক স্মৃতি থেকে ফিরে এলে ঘড়ির কাঁটা নায়ক রাজকে জানিয়ে দেয় রাত এখন ভরা যৌবনের পথে।

তিনি বলেন, সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাকি জীবনটা যেন কাটিয়ে দিতে পারি সে দোয়াই চাই। লক্ষীকুঞ্জ ছেড়ে আমাদের গাড়িটা এগিয়ে চলছে। কুঞ্জ আকাশে শুকতারাটা তখনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল...।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর