শিরোনাম
সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ সংকট

চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ সংকট

চলচ্চিত্র নির্মাণ হ্রাসের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনিয়োগ সংকট। পাইরেসি, প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা হ্রাস, প্রেক্ষাগৃহের মন্দ পরিবেশ, মানহীন নির্মাণ, মানসম্মত গল্প ও চিত্রনাট্যের অভাব, আকাশ সংস্কৃতি, ইন্টারনেটে অবাধে প্রাপ্তি, নির্মাতা ও শিল্পী সংকট, এফডিসিতে চলচ্চিত্র নির্মাণের উন্নত প্রযুক্তির ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা কারণে চলচ্চিত্রের ব্যবসা এখন ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। তাই ক্রমেই সবাই এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বেশ কজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলে এ নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

 

কাজী ফিরোজ রশীদ

[প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি]

ভালো ছবি এখন নির্মাণ হয় না। তাই সিনেমা হলগুলো দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সপ্তাহে একটি করে হলেও মানসম্মত ছবি পাওয়া যেত। এখন মাসে একটিও পাওয়া যায় না। কিছু ভালো গল্পের ছবি আবার সেন্সর ছাড়পত্র পায় না। যেমন ‘রানা প্লাজা’। এ ছবির মূল ঘটনা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষ সরাসরি দেখেছে। তাহলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনে আপত্তি কেন? ছবিটি মুক্তি পেলে নির্মাতা এবং সিনেমা হল মালিক উভয়েই উপকৃত হতো। দর্শকশূন্য সিনেমা হল চালাতে গিয়ে প্রচুর লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিককে। স্টাফদের বেতন, বিদ্যুৎ খরচ, ট্যাক্সসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ বহন করতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই নিরুপায় হয়ে সিনেমা হল ভেঙে মার্কেট তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছে হল মালিকরা। ভালো নির্মাতা, গল্পকার, শিল্পীর অভাবে দর্শক আর সিনেমা হলে ফিরছে না। তাই নির্মাতারাও এ খাতে আর বিনিয়োগ করতে চাইছেন না।

মিয়া আলাউদ্দীন

[সাধারণ সম্পাদক, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি]

আগে বেশির ভাগ সিনেমা হল মালিকই নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন ব্যবসায়িক পরিস্থিতির কারণে কেউ আর এ খাতে বিনিয়োগ করতে চান না। চলচ্চিত্র ব্যবসা এখন শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ। ভালো গল্প, নির্মাণ ও অভিনয়ের অভাবে চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস নেমেছে। অবাধ আকাশ সংস্কৃতি ও নেটের প্রচলনও এর জন্য দায়ী। যতদিন স্যাটেলাইট চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করা না যাবে ততদিন এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। অনেকের মতে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ছবির ব্যবসা করে না। কথাটির সঙ্গে আমি একমত নই।  ভালো ছবি হলে একটি প্রেক্ষাগৃহে দীর্ঘদিন তা প্রদর্শন হয় এবং মুনাফাসহ পুঁজি ফেরত আসে। ভালো গল্প, অভিনয়, নির্মাণ এবং প্রেক্ষাগৃহের উন্নত পরিবেশ ছাড়া চলচ্চিত্র ব্যবসাকে ঝুঁকিমুক্ত করা যাবে না। এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে একটি ছবি নির্মাণ করলে সেই টাকা ফেরত আসবে কোথা থেকে। ছয় বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘মনপুরা’ ছবিটির কথাই বলি। ছবিটি যে বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছিল সেই তুলনায় অর্থ ফেরত আনতে পারেনি।

ইফতেখার নওশাদ

[কর্ণধার মধুমিতা মুভিজ ও মধুমিতা সিনেমা]

১৯৯২ সালে বড় ভাই মো. সালাউদ্দীন ফারুক মারা যাওয়ার পরই নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছি। নির্মাণ বন্ধের  পেছনে অন্যতম মূল কারণ ছিল পাইরেসি। অন্য আরও কারণ তো আছেই। ছবি মুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যেই তা পাইরেসি হয়ে যাচ্ছে। এখন তো মুক্তির তিন দিনের মাথায় বাজারে ছবির পাইরেসি সিডি পাওয়া যায়। এতে চরম, লোকসানে পড়ে নির্মাতা ও সিনেমা হল মালিক। এ অবস্থায় এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় বিনিয়োগ কিভাবে হবে। এতে চলচ্চিত্র শিল্পই এখন ধ্বংসের মুখে। সরকার যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেয় তা হলে অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে চলচ্চিত্র শিল্প বলে আর কিছু থাকবে না।

খোরশেদ আলম খসরু

[সাবেক সি. সহ-সভাপতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি]

যতক্ষণ পর্যন্ত না পাইরেসি নির্মূল করা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউব আর নেটে ছবি চলে আসছে। প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা উদ্বেজনক হারে কমে গেছে। যেগুলো আছে তার মধ্যে বেশির ভাগেরই পরিবেশ ভালো নেই। এ অবস্থায় কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ছবি নির্মাণ করে তা যদি চালানো না যায় তাহলে প্রযোজক লাভের মুখ দেখবে কিভাবে।

বর্তমানে প্রেক্ষাগৃহে ডিজিটালের নামে ইলেকট্রিক্যাল প্রজেক্টর বসিয়ে দর্শকদের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে টেলিফিল্ম বানিয়ে দর্শকদের বোকা বানানো হচ্ছে। মানসম্মত গল্প, নির্মাতা আর অভিনয় শিল্পীর অভাব।

গুলিস্তানের ফুটপাতে যদি ১০ টাকা দিয়ে ছবির পাইরেটেড সিডি কিনতে পাওয়া যায় তাহলে ১০০ টাকা খরচ করে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখবে কেন? বর্তমানে দেশে মাত্র ৩২২টির মতো প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। তাই কোটি টাকা ব্যয় করে ছবি নির্মাণ করে সেই টাকা তুলবে কোথা থেকে।

আবদুল আলীম

[কর্ণধার. মনোয়ারা ফিল্মস ও প্রেক্ষাগৃহ মালিক]

ছবির দর্শক অনেক বেড়েছে। কিন্তু পরিচালক ও শিল্পী নেই। ভালো প্রযোজকেরও অভাব। ভালো প্রযোজক না হলে ভালো ছবি হয় না। এখন বেশির ভাগ প্রযোজক আসেন কালো টাকা সাদা ও ফুর্তি করতে। পাইরেসিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটি আজীবন সারা দুনিয়ায় ছিল। ছবি ভালো হলে দর্শক তা দেখতে অবশ্যই সিনেমা হলে আসে। ভালো ছবির অভাবে দর্শক হলবিমুখ হওয়ায় আমার সাতটি সিনেমা হলের মধ্যে চারটিই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। নির্মাণও বন্ধ করে দিয়েছি। আমার প্রযোজনা সংস্থা থেকে ৩৯টি ছবি নির্মাণ করেছি। সবই ব্যবসাসফল। এসব ছবি থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করেছি। এখন আর ঝুঁকির কারণে সাহস হচ্ছে না।

মোহাম্মদ হোসেন

[কর্ণধার, সনি সিনেমা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক]

চলচ্চিত্র ব্যবসা এখন এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে যে, পুঁজিই ফেরত আনা সম্ভব হচ্ছে না। পাইরেসি, ভালো নির্মাতা, গল্প, শিল্পী আর প্রদর্শনের অব্যবস্থার কারণে চলচ্চিত্রের ব্যবসা আর অনুক‚লে নেই। তাই সবাই আস্তে আস্তে এই ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে।

সামসুল আলম

[আনন্দ সিনেমা]

এখন নির্মাতা হতে আর কোনো যোগ্যতা লাগে না। সহজেই যে কেউ ছবি নির্মাণ করতে পারছে। আর ডিজিটালের নামে চলছে প্রতারণা। ফলে দর্শক প্রতারণার ফাঁদে পড়ে দেশীয় ছবি ও প্রেক্ষাগৃহবিমুখ হচ্ছে। পাইরেসি আর সিনেমা হলের নোংরা পরিবেশ তো আছেই। ইউটিউবেও এখন ছবি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে তা পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে এই ব্যবসায় এমনই ধস নেমেছে যে, এতে এখন ঝুঁকির কারণে কেউ আর বিনিয়োগ করতে চায় না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর