বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণা

আলাউদ্দীন মাজিদ

যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণা

যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত চার ছবি

যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণে হঠাৎ হিড়িক লেগেছে। বিষয়টিকে শুরুতে ভালো উদ্যোগ মানে মরা গাঙে জোয়ার এসেছে বললেও এ নিয়ে এখন চলচ্চিত্রমহল মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছে। যৌথ প্রযোজনার নামে ভারতের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টাই এই দুশ্চিন্তার কারণ।

যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ নতুন কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই নানা দেশের সঙ্গে এই নিয়মে অজস্র ছবি নির্মাণ হয়েছে। তখন যে নীতিমালার অধীনে ছবি নির্মাণ হয়েছে তাতে দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু হুট করে ২০১২ সালে নিজ দেশের সুযোগ-সুবিধাকে জলাঞ্জলি দিয়ে এ দেশের নীতিমালা সংশ্লিষ্টরা যে হঠকারী নীতিমালা তৈরি করেছেন তাতে এখন বরাবরই প্রতারণার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। চলচ্চিত্রমহল দাবি জানাচ্ছে, অবিলম্বে ক্ষতিকর এই নীতিমালা বাতিল করা হোক। ১৯৮৬ সালের যৌথ প্রযোজনা নীতিমালায় বলা হয়, সব দেশের শিল্পীদের সমানহারে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বাধ্যতামূলক। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাধিক যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মিত হয়েছে। ২০১২ সালে  সে নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়। এতে বলা হয়, দুই দেশের নির্মাতারা আলোচনার মাধ্যমে ছবি নির্মাণের বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবেন। এ সিদ্ধান্তই এখন বাংলাদেশের নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একটি সূত্র নতুন অভিযোগ এনে বলছে, মূলত অর্থ পাচারের জন্যই ছবিগুলোর বাংলাদেশি ভার্সনে যৌথ প্রযোজনার নাম দেওয়া হয়।

২০১৪ সালে নির্মাতা অনন্য মামুনের হাত ধরেই মূলত ২০১২ সালের নীতিমালার অধীনে  যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ শুরু হয়।  ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ শিরোনামের যৌথ প্রযোজনার ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়েই তিনি  যৌথ প্রতারণার কবলে পড়েন। শুরু হয় শুভঙ্করের ফাঁকি। এতে নায়ক-নায়িকা চরিত্রে বাংলাদেশের কাউকেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনে তীব্র সমালোচনার ঝড়  তৈরি হয়। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি ব্যবস্থা নেয় অনন্য মামুনের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালে একই কায়দায় জাজ মাল্টিমিডিয়া নির্মাণ করে ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’ নামে আরেকটি যৌথ প্রতারণার ছবি। এটি নিয়েও চলচ্চিত্রকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এ ছবিতে নায়কের চরিত্রে ওপার বাংলার অঙ্কুশ এবং নায়িকা চরিত্রে বাংলাদেশের মাহিয়া মাহি থাকলেও কলকাতার ছবির পোস্টার এবং টাইটেলে ছিল না বাংলাদেশের নির্মাতা আবদুল আজিজের নাম। এ নিয়ে এখনো বিতর্ক থামেনি। এমন বিতর্কের মাঝেও চলতি বছর জাজ আবারও ‘আশিকী’ নামে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ করে। এ ছবির ভারতীয় ভার্সনে পরিচালক কিংবা প্রযোজক হিসেবে বাংলাদেশের কারও নাম ছিল না। অথচ প্রতারণার বিষয়টি ঢাকতে বাংলাদেশে প্রদর্শিত পোস্টার এবং ছবির টাইটেলে পরিচালক হিসেবে কলকাতার অশোক পতির নামের পাশে জাজের কর্ণধার আবদুল আজিজের নাম ব্যবহার করা হয়।

আগের যৌথ প্রতারণার তিন ছবির বিতর্ক না থামতেই এখন এর সঙ্গে যোগ হলো ‘ব্ল্যাক’ নামের কথিত একটি যৌথ প্রযোজনার ছবি। এ ছবিতে কলকাতার নায়ক সোহমের বিপরীতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের বিদ্যা সিনহা মিম। কলকাতার রাজা চন্দের সঙ্গে  যৌথভাবে বাংলাদেশের কামাল কিবরিয়া লিপুর নামও পরিচালনায় রয়েছে বলে প্রযোজনা সূত্র বরাবরই দাবি করে আসছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের কিবরিয়া ফিল্মস ও কলকাতার দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া প্রযোজনার দায়িত্বে রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে ছবির মহরত অনুষ্ঠানে। অথচ সম্প্রতি কলকাতার দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়ার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ‘ব্ল্যাক’-এর অফিসিয়াল টিজারে  দেখা গেছে যৌথ প্রযোজনা তো দূরের কথা, বাংলাদেশের পরিচালক কিংবা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নামের ছিটেফোঁটাও নেই তাতে। টিজারে পরিচালক হিসেবে শুধু নাম দেওয়া আছে রাজা চন্দের। এ ছাড়াও প্রযোজক হিসেবে কলকাতার রানা সরকারের নাম রয়েছে। প্রতারণার বিষয়টি এখানেই থেমে ছিল না। যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা দুই  দেশে শুটিং করার শর্তও পূরণ করা হয়নি। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে শুধু ভারত ও ব্যাংককেই ছবির শুটিং শেষ করা হয়। এ নিয়ে আবার এ দেশের চলচ্চিত্রপাড়া সরগরম হয়ে উঠলে রাজা চন্দ লোকদেখানো কায়দায় এবং প্রতারণার বিষয়টি ঢাকতে হুট করে একটি গানের শুটিংয়ের অবতারণা করেন। আর এই শুটিং করতে গত সপ্তাহে নায়ক সোহমকে নিয়ে কক্সবাজার উড়ে আসেন। একটি সূত্র জানায়, ছবির পুরো চিত্রায়ণের কাজ আগেই শেষ হয়। বাংলাদেশে শুটিং না করায় যৌথ প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় বাড়তি গান যোগ করে বাংলাদেশে লোকদেখানো শুটিংয়ের আয়োজন করেন রাজা চন্দ। তা ছাড়া যেসব শিল্পীকে নিয়ে শুটিংয়ে এসেছেন তিনি তাদের অনেকের ওয়ার্ক পারমিট না থাকারও অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, ৩০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ওই শুটিংয়ে অংশ নেন ২৫ জন ভারতীয় শিল্পী-কলাকুশলী। অভিযোগ রয়েছে, তাদের কারোই ওয়ার্ক পারমিট নেই। যদিও স্থানীয় নির্মাতা কিবরিয়া লিপু বলছেন, অভিযোগ অসত্য। অ্যাম্বাসির অনুমতি নিয়েই কাজ করছেন তারা।

যৌথ প্রযোজনার ছবির ক্ষেত্রে এ ধরনের বিস্তর অভিযোগ এখন সাধারণ ব্যাপার বলছেন সিনিয়র চলচ্চিত্রকাররা। তারা বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিককালের এ ধরনের যৌথ প্রযোজনার ছবির বিষয়ে নায়করাজ রাজ্জাকের কাছে জানতে চাওয়া হলে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটি স্মাগলিং ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, এসব ছবি ভারতে চলে না। আমাদের ছবির বাজার দখল করার হীনচেষ্টার অংশ হচ্ছে কথিত এসব যৌথ নির্মাণ। এই অপরাধ সম্মিলিতভাবে এখনই প্রতিরোধ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর