শনিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পায়ে পায়ে সুরের পথে

আলাউদ্দীন মাজিদ

পায়ে পায়ে সুরের পথে

১৯৬৫ সালের জুন মাস। সংগীতাকাশে ভেসে উঠল একটি উজ্জ্বল তারা। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা। আগামী ১৭ নভেম্বর এই কিংবদন্তি শিল্পীর জম্নদিন। বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতির গর্ব তিনি। ৫০ বছর ধরে সুরের আলো ছড়িয়েই যাচ্ছেন অবিরত। গানকে প্রাণের সঙ্গে বেঁধে হেঁটে চলেছেন দীর্ঘ পথ। কণ্ঠে মরিচা ধরেনি এতটুকুও। জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

‘শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাব, তোমাদের মন ভরাব’ হ্যাঁ শিল্পী হতে চেয়েছিলেন রুনা লায়লা। ছোটবেলায় এ ইচ্ছাটা তার কচি মনে ছায়া ফেলে। ইচ্ছা পূরণে এগিয়ে আসেন মা। প্রথমে নাচ শেখেন। তখনো গানের পোঁকা মাথায় ঢোকেনি। চার বছর বয়সে নাচ শেখা শুরু। কত্থক, কত্থককলি, ভরত নাট্যম প্রভৃতি। তারপর নিজের অজান্তেই গানের জগতে চলে আসা রুনা লায়লার।

১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর সিলেটে জম্ন রুনা লায়লার। তার পিতা সৈয়দ মোহাম্মত ইমদাদ আলী একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তার কর্মস্থল ছিল লাহোরে। বড় বোন দীনা লায়লা ও রুনা লায়লা করাচির এক স্কুলে পাঠ্য জীবন শুরু করেন। ছোটবেলা থেকেই পাকিস্তানের প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী আহমেদ রুশদীর ভক্ত ছিলেন তিনি। বলা হয় রুনা লায়লার গানের অনুপ্রেরণা ও স্টাইল আহমেদ রুশদীকে অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে। রুশদীর ‘হিপ অপ’, ‘রক অ্যান্ড রোল’ ‘ডিসকো’ ঘরনার গানগুলো রুনা লায়লার মনে রেখাপাত করে। পরবর্তীতে দুজনে অনেক জনপ্রিয় গানে একসঙ্গে কণ্ঠ দেন। বড় বোন সংগীতশিল্পী দীনা লায়লা ১৯৭৬ সালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা গেলে বোনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১০টি চ্যারিটি শো করেন ঢাকায়। চ্যারিটি শো থেকে আয়কৃত অর্থ দিয়ে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন দীনা লায়লার নামে একটি ক্যানসার হাসপাতাল। রুনা লায়লা হলেন সার্কের এইচ আইভি ও এইডসবিষয়ক প্রথম  বাংলাদেশি শুভেচ্ছাদূত। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রচুর চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা। এ ছাড়া রয়েছে তার অজস্র জনপ্রিয় আধুনিক, গজল, ফোক ও পপ গান। ৬ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২ বার পাকিস্তানের নিগার অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন এই সংগীতব্যক্তিত্ব। রুনা লায়লার ব্যক্তি ও সংগীত জীবন নিয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম নব্বইয়ের দশকে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘শিল্পী’। এতে নিজের চরিত্রে অভিনয় করেন ও চলচ্চিত্রটির গানে কণ্ঠ দেন রুনা লায়লা।

উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা অবারিত পূর্ণতার আলোতে দাঁড়িয়ে নিজের শিল্পী জীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে এখনো আনমনে হারিয়ে যান ফেলে আসা দিনগুলোতে। মা গাইতেন। বড় বোন দিনা লায়লা গান শিখতেন। রুনার তখন ৩/৪ বছর বয়স। খেলতে খেলতে এসে বড় বোন যা গাইতেন তা নিজের কণ্ঠে তুলে নিতেন আর ওস্তাদজিকে গেয়ে শোনাতেন।

ছয় বছর বয়সে প্রথম স্টেজে গান। নয় বছর বয়স, করাচিতে থাকতেন। সেখানে আন্তঃস্কুল গানের প্রতিযোগিতা হয়। স্কুলের পক্ষ থেকে গেয়ে প্রথম পুরস্কার পান। বড় অ্যারেঞ্জমেন্টের দিক থেকে এটি তার প্রথম বড় মাপের পুরস্কার লাভ।

১৯৬৫ সালে বয়স ১২ বছর। লাহোর থেকে একজন মিউজিক ডিরেক্টর ও প্রডিউসার এলেন। তারা বড় পর্দায় ১০/১২ বছরের একটি বাচ্চা ছেলের কণ্ঠের গান চিত্রায়ণ করবেন। তখন রেডিও পাকিস্তানে আন্তঃস্কুল গান প্রতিযোগিতা প্রচার হয়। রেডিও থেকে তাদের জানানো হয় বছর তিনেক আগে একটি মেয়ে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। ওকে নিয়ে ট্রাই করে দেখতে পারেন। ছবির নাম ‘জগনু’। গানের কথা ‘গুরিয়সি মুন্নি মেরি ভাইয়াকি পেয়ারি’। স্যাড গান। গানটি যখন তিনি গান, মাইক্রোফোনের সামনে গাইতে গাইতে আবেগে কেঁদে ফেলেন। এমনভাবে কাঁদছিলেন যে, সেই কান্না আর থামেই না। পরে চকলেট দিয়ে তার কান্না থামানো হলো।

১৯৭৪ সালে ঢাকায় আসেন। পরিবারের সঙ্গে করাচিতেই থাকতেন। বাবা সেখানে সরকারি চাকরি করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সরকারের পক্ষ থেকে বাবাকে অপশন দেওয়া হলো পাকিস্তানে থাকবেন নাকি বাংলাদেশে চলে যাবেন। তখন পরিবারের সবাই এক বাক্যে বললেন, বাংলাদেশে চলে যাব, এখানে আর থাকব না। ১৯৭৪ সালে দেশে আসার পর সত্য সাহার সুরে প্রথম প্লে-ব্যাক ঢাকায়। ছবির নাম ‘জীবন সাথী’। খন্দকার ফারুক আহমেদের সঙ্গে ডুয়েট গান। ১৯৬৮ সালে বাংলা ছবিতে গান করার জন্য প্রথম আমন্ত্রণ পান। চিত্রপরিচালক নজরুল ইসলাম আর সংগীত পরিচালক সুবল দাস ‘স্বরলিপি’ ছবির গান রেকর্ডিং করতে যান লাহোরে। ছবির একটি গান রুনাকে দিয়ে গাওয়ানোর পরিকল্পনা করেন। রুনা লায়লা তখন দারুণ ব্যস্ত। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে গান। একই দিনে বিভিন্ন স্টুডিওতে ছয়-সাতটি গান রেকর্ডিং চলছে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গান রেকর্ডিং করতে হয়। লাহোরের বারি স্টুডিওতে রেকর্ডিং করা হয় গানটি। শিরোনাম ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। বাংলাদেশে আসার আগে আর কোনো বাংলা ছবিতে গান গাওয়া হয়নি তার। মোট ১৮টি ভাষায় গাইতে পারেন এই অবিসংবাদিত কণ্ঠশিল্পী। প্রতিদিন ১০টি করে তিন দিনে ৩০টি গান রেকর্ড হওয়ায় গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম ওঠে তার। পাকিস্তানের প্রখ্যাত কম্পোজার আজমি। তার অনেক ছবির গান করেছেন। গানগুলো শোনার পর মুম্বাইয়ের একটি রেকর্ড কোম্পানি প্রস্তাব করল, গানগুলো তারাও রেকর্ড করতে চায়। তাই ১০টি করে তিনদিনে ৩০টি গান রেকর্ড হয়েছিল। ঘটনাটি গিনেস বুকে ওঠে। ১৯৮৩ সালে প্রকাশ হয় প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার রুনা’। একদিনে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। এটা গোল্ড রেকর্ড। আর এ জন্য এইচএমভি থেকে গোল্ড ডিস্ক পেয়েছিলেন রুনা লায়লা। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে কেনেডি সেন্টারে তার প্রথম কনসার্ট ছিল। সেখানে তিনি ছিলেন প্রথম কোনো এশিয়ান শিল্পী। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি পতাকা উড়ানো হয়। জিমি কার্টার তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সপরিবারে এসেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে স্টেজে এসে তারা রুনার গানের প্রশংসা করেন।

সংগীতের এই কিংবদন্তি বলেন, আমি গর্ববোধ করি যে, আমি বাংলাদেশি একজন শিল্পী। সব সময় বাংলাদেশকে দেশের বাইরে তুলে ধরার চেষ্টা করি। যেখানেই যাই, বলা হয় ‘রুনা লায়লা ফ্রম দ্য বাংলাদেশ’ অথবা ‘রুনা লায়লা অব দ্য বাংলাদেশ’। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই গর্বের। ৫০টি বছর ধরে গেয়ে যাচ্ছি। পথটাকে খুব দীর্ঘ মনে হয় না কখনো। মনে হয়, এই তো সে দিনের কথা। সময় কত দ্রুত বয়ে যায়। তবুও আগামীর পানে তাকিয়ে রই...।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর