রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
বাংলাদেশ প্রতিদিন-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে পবন দাস বাউল

একটা সময় গান গেয়ে ভিক্ষা করেছি

আলী আফতাব

একটা সময় গান গেয়ে ভিক্ষা করেছি

ঢাকা ফোক ফেস্টিভ্যালে পবন দাস বাউল

‘ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্টিভ্যাল’-এ অনেক শিল্পীর ভিড়ে সবার চোখ আটকে ছিল প্যারিস প্রবাসী পবন দাস বাউলের দিকে। দূরপ্রবাসে থাকলেও তার অঙ্গে মেখে আছে বাংলার গান। শুধু গায়কীতেই তিনি আলাদা নন, আচরণেও। তিনি শিশুর মতো সরল একটি মানুষ। শিল্পী মননে এবং মগজে। তাই তো তার গান হৃদয় ছুঁয়ে যায়। গান পরিবেশন শেষে গ্রিন রুমে কথা হয় তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- আলী আফতাব

 

অনেক দিন পর আবারও বাংলাদেশে এলেন। কেমন লাগছে?

জানি বললে বিশ্বাস হবে না। আমার প্রতিটি অঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বাংলা। বাংলাদেশের গান শুনে বড় হয়েছি। রেডিও ঘুরিয়ে আমরা বাংলাদেশের গান শুনতাম। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক, আমার গানচর্চার মতোই গভীর।

আপনি তো আগেও ঢাকায় গেয়েছেন। এবারও গাইলেন। কেমন এখানকার শ্রোতারা?

প্রথমবার ঢাকায় এসে গান করারই সুযোগ পাইনি। কী এক অজ্ঞাত কারণে আমার সংগীত বাতিল করে দেওয়া হয়। পরেরবার যখন আসি, তখন চারদিকে ছিল সুনামির হাহাকার। সে কারণে মনটা বিষাদে ছেয়েছিল। আর এবার আন্তর্জাতিকভাবে লোকসংগীত উৎসব আয়োজন নিঃসন্দেহে অনেক বড় বিষয়। এমন আয়োজনে অংশ নিতে পেরে সত্যিই আমার ভালো লাগছে। এই আয়োজনের শ্রোতারাও অসাধারণ।

এবার বাংলাদেশের দর্শকরা আপনাকে একটু নতুন রূপে দেখল। অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের সঙ্গে ফিউশন করেছেন। কীভাবে হলো এটি?

আমি কেবল বুনোকে চিনতাম। অর্ণবের সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল না। বাউল গানের প্রতি বুনোর ভালোবাসা আছে। সে পাশ্চাত্য ঘরানার সংগীতের সঙ্গে একাধিক লোকজ গান ফিউশন করেছে। ওই গানগুলো আমার অনেক ভালো লেগেছে। অর্ণবের সঙ্গে পরিচয় বুনোর বন্ধু হিসেবে। প্রথম পরিচয়েই অর্ণবকে আমার অনেক ভালোলাগে। তার গানের ধারা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সে কারণেই অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের সঙ্গে বাউল গানের ফিউশন করেছি। ভালো লেগেছে এই অভিজ্ঞতা। তারা মেধাবী।

ফিউশন তো অনেকের ভালো লাগে না। আপনার কেন লাগল?

ভিন্নধারার সংগীতের মিশ্রণকে যে ফিউশন বলে, সেটাই জানতাম না। আমি এই বিষয়টি জেনেছি ব্রিটিশ মিউজিশিয়ান স্যাম মেলসের কাছ থেকে। তার সঙ্গে আমি অনেকটা সময় কাটিয়েছি। তিনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। স্যাম মেলস আমার সঙ্গে গান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তো বাউল, তিনি ভিন্নধারার সংগীতায়োজক। আমরা একসঙ্গে গান করব কীভাবে? এটাই ছিল আমার উদ্বেগ। এর পর আমাকে তিনি বুঝিয়েছেন কীভাবে ফিউশন গান তৈরি হয়। এরপর আমরা একসঙ্গে কাজ শুরু করি। ভিন্ন স্বাদের এই ফোক আয়োজন করতে গিয়ে মনে হয়েছে, ফিউশনটা একেবারে মন্দ নয়। এরপর ‘রিয়েল সুগার’ অ্যালবাম প্রকাশ করি। এর গানগুলো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ ফিউশন। এতে বাউল গানের আদল ধরে রেখে পাশ্চাত্যের সংগীতায়োজনে তা রেকর্ড করা হয়েছে। এটিও চমৎকার এক অভিজ্ঞতা।

নতুন প্রজম্মোর কাছে লোকগানের গ্রহণযোগ্যতা কেমন বলে আপনি মনে করেন?

একটি জিনিস খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, বেশ কয়েক বছর ধরে তরুণরা ব্যান্ড গড়ার প্রতি বেশি আগ্রহী। শুরুর দিকে পপ, রক, মেটাল নিয়ে তারা নানা রকম আয়োজন করত। এখন অনেকেই ফোক গান করছে। কয়েকটি ব্যান্ডকে আমার গানও পাশ্চাত্য ঘরানার সংগীতের সঙ্গে গাইতে দেখেছি। তারপরও কোনো প্রশ্ন করিনি- কেন তারা হঠাৎ ফোক গান গাওয়া শুরু করেছে? কারণ, উত্তরটা আমার জানা। আমি খুব ভালোভাবেই জানি, ফোক বা মাটির গানের আবেদন। যুগের হাওয়ায় গা ভাসালেও শিকড়ের টানে নতুন প্রজম্মোর শিল্পী ও সংগীতায়োজকদের বার বার তাদের মাটির কাছেই ফিরে আসতে হবে। বাংলাদেশের এ উৎসব থেকেও নতুন প্রজম্মোর অনেকেই শিকড়ের গানের প্রতি উৎসাহিত হবেন- নিঃসন্দেহে। এই উৎসব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফোক শিল্পীদের মাঝে একটি বন্ধন তৈরি করে দেবে।  লোকগানের শ্রোতা দিনের পর দিন বাড়ছে বলেই আমার ধারণা। নইলে আন্তর্জাতিকভাবে এত বড় উৎসবের আয়োজন করা হতো না।

বাংলাদেশের লোকশিল্পীদের গান শোনা হয়?

এই বাংলায় আমার বেশ কিছু প্রিয় শিল্পী আছেন। তার মধ্যে আব্বাসউদ্দীন আহমদ, আবদুল আলীম, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মুজিব পরদেশীর গান আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাদের অনেক অ্যালবাম এখনো আমার সংগ্রহে আছে। সময় পেলে শুনি।

 

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গ। বাউল হলেন কেন?

বাউল হওয়ার পেছনে আমার লুকিয়ে আছে এক কষ্টের গল্প। আমার মনে বাউল ভর করে বাবার সঙ্গে গানের বিনিময়ে ভিক্ষা করতে করতে। যদিও আমার বাবা দিবাকর দাস জাত বাউল ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের মোহাম্মাদপুর গ্রামের এক কৃষক। কৃষিকাজ করলেও সংগীতের নেশায় আসক্ত ছিলেন। বিভিন্ন উৎসবে তিনি কীর্তন গাইতেন। আমার ৬ বছর বয়সে হঠাৎ এক দিন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করতে হয়। সংসারে অনটন বাড়তে থাকে। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষায় বের হন। বাবা গাইতেন আর আমি দোহারি করে নাচতাম। গান শুনে লোকেরা দুপয়সা দিত। তা দিয়ে আমাদের সাতজনের অন্ন জুটে যেত। এভাবেই হাটে-বাজারে, পথে-প্রান্তরে, ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করেছি। চলতে চলতে অসংখ্য ফকির আর সাধুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের জীবন প্রণালি আমাকে আকৃষ্ট করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাউল জীবনের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। কখন যে পুরোপুরি বাউল বনে গেছি, বুঝতেই পারিনি।

বাউল জীবনের দর্শন নিয়ে কিছু বলুন।

আমি ভাই জ্ঞানী মানুষ নই। আমি তাদের মতো করে জীবন দর্শন বুঝাতে পারব না। আমি পড়াশোনার সুযোগ পাইনি। বাবার কাছে বাল্যশিক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ কেবল পড়েছি। জ্ঞান-বুদ্ধির যেটুকু প্রসার ঘটেছে তা ফকির-সন্ন্যাসীর সঙ্গ পাওয়ায়। সে কারণে দর্শনের মতো গভীর বিষয়ে কথা বলা আমাকে মানায় না। বাউল জীবন বলতে আমি কেবল এটা বুঝি- ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবান যাই বলি না কেন, তিনি কোনো উপাসনালয়ে থাকেন না; থাকেন আত্নার গভীরে।

দিনমান তাই নিজের মাঝে তার অনুসন্ধান করতে হয়। বাউলরা গানে গানে অনুসন্ধান চালিয়ে যান। আমিও আত্নানুসন্ধানে বাউল জীবন বয়ে চলছি।

প্যারিস গেলেন কীভাবে?

ঘটনাটা কাকতালীয় বলা যায়। ‘পাগলদের গান’ তথ্যচিত্র দেখার পর ১৯৮১ সালে রেডিও ফ্রান্সের কর্মকর্তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানান। যার সুবাদে ৩০ বছর বয়সে আমি প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা করি। ১৯৮২ সালে ফ্রান্সের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আবার আমন্ত্রণ জানায়। তারপর থেকেই কলকাতা-প্যারিস নিয়মিত যাতায়াত করেছি। এখন তো প্যারিসেই সময়টা বেশি কাটে আমার।

আপনার কাছে জীবনের সংজ্ঞা কী?

আমার কাছে জীবন মানে অন্তহীন ভ্রমণ। আমার ভ্রমণের সঙ্গী বাউল গান। সামান্য সময়ের জন্য এসেছি পৃথিবীতে; চলেও যাব যে কোনো সময়- এই সত্য আমার মন থেকে কখনো হারায় না। তাই নিজেকে, ঈশ্বরকে, সত্যকে খুঁজে ফিরি। আমি খুব লেখাপড়া জানা মানুষ নই; পথই আমাকে শিখিয়েছে। মানুষ দেখে, মানুষের কাছ থেকে শিখি। আরও সহজ করে বললে- মানুষই আমার কাছে জীবন।

সর্বশেষ খবর