সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসব

শেষ হলো মুগ্ধতার তিন রজনী

আলী আফতাব

শেষ হলো মুগ্ধতার তিন রজনী

তিন-তিনটে রজনী ঢাকার শ্রোতারা বুঁদ হয়েছিলেন সুরের মূর্ছনায়। এই যান্ত্রিক নগরেও তারা ভেসে গিয়েছেন আদিম ধুনে। শেষ দিনের আসর যখন শেষ হলো, তখন কারও মধ্যে বিরহ নেই। কারণ তখনো সবাই স্মৃতিকাতর আর মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ। বেদনা পর্ব শুরু হবে আরও পরে, আর সেই সঙ্গে অপেক্ষা আগামী বছরের জন্য। কারণ ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসব’ মাত্র শুরু হলো, শেষ নেই। চলবে বছরের পর বছর এমনটাই জানাল আয়োজকরা। প্রথম দুই দিনের মতো শেষ দিনও ছিল বেশ জমজমাট আসর।

শুরু হয় জলের গানে। রাহুল আনন্দ নেচে গেয়ে মাতালেন সবাইকে। জলের গানের দলের সব সদস্যের গানের গলা আছে সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রত্যেকের হাতে যে বাদ্যযন্ত্রগুলো, সেগুলোতে তুন আর ধুন তারা যেভাবে তুলেছেন তাতে বাদ্যেও তারা সেরা সে কথা বলা মোটেই বাহুল্য নয়। পুরো পরিবেশনাটি ছিল ছন্দময়। অসাধারণভাবে ধারাবাহিক। দর্শককে ধন্য ধান্য পুষ্পে ভরা... গাইয়ে আর পরবর্তী ব্যান্ডদল নিয়াভ নি কারাকে বাদ্যের তালে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তবেই মঞ্চ ছাড়ল জলের গান।

নিয়াভ নি কারা আয়ারল্যান্ডের ফোকশিল্পী। তাকে ঈশ্বরপ্রদত্ত সুরশিল্পীই ডাকা হয়। ২০১৪ সালে ফিমেল মিউজিশিয়ান অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন। আর গানে হাতেখড়ি চার বছর বয়স থেকে। একাই গান নিয়াভ নি কারা। সঙ্গে দুজনের একজন গিটার আরেকজন ছোট্ট ড্রাম বাজান। আর নিয়াভ নি ম্যান্ডোলিন হাতে সুরের ঢেউ তোলেন আর মিষ্টি সুরে গান ধরেন। ব্যর্থ প্রেমিকের গান, লোকলজ্জায় পড়া পুরুষের গান। আর মাঝে মাঝে কনসার্টিনা বাজিয়ে জানান দেন কী দারুণ দক্ষতা তার হাতে।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আর বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়েরকে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি করে মঞ্চে মূল আয়োজক সান ফেস্টর ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর উপস্থিতি ও আনুষ্ঠানিকতাটুকু সেরে নেওয়ার মধ্যেও ছন্দ ছিল। বক্তব্যে পরিমিতি বোধের কারণেই হয়তো সেটুকু গ্রহণ করে নিয়েছিলেন সংগীতপ্রেমী দর্শকরা। আসাদুজ্জামান নূরের মাটির টান, শিকড়ের সন্ধান আর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা ভুলে না যাওয়ার আহ্বানে দর্শকের সাড়া ছিল দারুণভাবে।

মঞ্চ-গানে ফেরে ইন্ডিয়ান ওশেন-এর পরিবেশনা দিয়ে। ওদের বলা হয় ভারতের রক-ফোক ব্যান্ড দল। ফোক আর রক দুই ধারার দুই গান। কিন্তু সেই বিপরীতমুখী দুই ধারাকে এক ক্যানভাসে কী দারুণ করে সাজানো যায় তা ইন্ডিয়ান ওশেন ছাড়া আর কেউ ভালো জানবে না। কারণ তাদের এই চেষ্টা প্রায় আড়াই দশকের।

এরপর পার্বতী বাউল। এ কোন বাউল, কেমন বাউল? দেখে মনে হবে ছোট্ট মেয়েটি। কিন্তু তার বোলের আর বেশের বাউলিয়ানায় এরই মধ্যে পূর্ব-পশ্চিম মুগ্ধ। এবার মাতালেন বাংলাদেশকে। কানায় কানায় পূর্ণ আর্মি স্টেডিয়াম পার্বতীর পরিবেশনায় মুগ্ধ।

আলী আলী বন্দনায় পাকিস্তানের সুফি কুইন আবিদা পারভীনের পরিবেশনা যখন শুরু হলো তখন রাত ১০টা পেরিয়ে গেছে। তখনো দর্শক ঢুকছে স্টেডিয়ামে। যেন নাইট ইজ স্টিল ইয়াং। আবিদার পরিবেশনায় ছিল উপমহাদেশের এক অসাধারণ মেলবন্ধন।

প্রথম দুই দিন মানুষ যে রেশ পেয়েছে শেষ দিনও তার ধারাবাহিকতা ছিল। মানে ‘শেষটা’ ভালো। আর তাই বলাই যায়, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। আসলেই ‘সব ভালো’। কারণ প্রথম দিন ছিল ফোক দুনিয়ার পদার্পণের দিন। প্রথম দিনই ফরিদা পারভীন, চন্দনা মজুমদার, কিরণ চন্দ্র রায়, অর্ক মুখার্জি, সাঁই জহুর, পাপন অ্যান্ড দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জমিয়ে দিয়েছিলেন আসর। তাই তো দলবেঁধে দ্বিতীয় দিনেও এসেছিলেন সবাই। সঙ্গে জোয়ারে ভেসে এসেছেন আরও দর্শক। তাই দ্বিতীয় দিনে দর্শক-রেকর্ড। ৬০ হাজারেরও বেশি শ্রোতা ছিল। আর তাদের মাতিয়েছেন পবন দাস বাউল, অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস, মমতাজরা।

প্রথম দুই দিন জমজমাট আসর দেখে তৃতীয় দিনেও তাই ঢল নামে দর্শকের।

আসর শেষ। কিন্তু শ্রোতাদের মনে গুনগুন করে বাজছে এখনো তিন দিনের সংগীত। তারা গাইছেন। আর এর মধ্য দিয়ে শ্রোতাদের মনে আবারও জীবন্ত হয়ে উঠেছে শিকড়ের গান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর