মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঢাকার চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঢাকার চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ

দেশাত্মবোধ বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সদ্য স্বাধীন দেশ সুশাসনের আওতাভুক্ত হওয়ার পর থেকেই স্বজাতি চেতনায় উন্মুখ হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতি। এই ধারায় জীবনঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রয়াসী হন চলচ্চিত্রকাররা। তারা রাজনীতি সচেতন এসব ছবি সাধারণ জনগণের কাছে প্রদর্শনের সাহস দেখিয়েছিলেন।

পঞ্চাশ দশকে ভাষা আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল সে পরম্পরা একাত্তরে এসে শক্তিতে পরিণত হয়। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মাণ হয় একাধিক ছবি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন আর ১৯৬৮-৬৯ এর গণআন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে মিছিল-বিক্ষোভে ফেটেপড়া রাজপথে দাবি আদায়ে প্রতিবাদী মানুষের জীবন ছবি সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী করেন জহির রায়হান। সংগ্রামী জনতার কাতারে এসে তিনি একাত্মতায় মিলেমিশে সংগ্রামের ভাষা নিয়ে চলচ্চিত্রের পর্দায় তুলে আনেন মুক্তিযুদ্ধে বিবেক জাগ্রত করার তাড়না ‘জীবন থেকে নেয়া’। পরম মমতায় সত্যনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন চলচ্চিত্রটি। এর মাধ্যমে তিনি দেশপ্রেমের বীজ বুনে গেছেন। জহির রায়হানের বাস্তবছোঁয়া চিত্রায়ণ দেখতে বাঙালি জাতির আরও কিছুদিন প্রহর গুনতে হয়। যুদ্ধ, গণহত্যা, বীভৎসতা প্রামাণ্যচিত্রে মর্মস্পর্শী তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’-এ স্থান পায়। একই সময় নির্মাতা ফররুক আলম তৈরি করেন ‘জয়বাংলা’। বাঙালির গণহত্যা কেমন হতে পারত, কেমন হতে পারে আর কেমনটি হয়েছিল তার সচিত্র প্রতিবেদন ‘স্টপ জেনোসাইড’। জহির রায়হান এই প্রামাণ্য চিত্রটি ছাড়াও ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ নামে আরও একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। তার বিষয় ছিল বাংলাদেশের জন্ম। দীর্ঘ সংগ্রাম আর নয় মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে যে মানচিত্র হয়েছিল সেটিই ‘এ স্টেজ ইজ বর্ন’। আলমগীর কবীর তৈরি করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’, বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’। এ চারটি প্রামাণ্যচিত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল। এগুলো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চিত্রায়িত। এ প্রামাণ্য ছবিগুলো ইংরেজি ধারা বর্ণনায় নির্মিত। এসব ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করা।

‘স্টপ জেনোসাইড’ তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে প্রথম সফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ছবি ‘ওরা ১১ জন’ (১৯৭২)। যুদ্ধকালীন সময়ের সম্পূর্ণ চিত্র দর্শকদের সামনে তুলে ধরে তাদের শিহরিত করেন নির্মাতা। এখানেই একজন নির্মাতার সার্থকতা। ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা, সংগঠিত হওয়া, যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে। নির্মাতা বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে রূপক অর্থে ছবির শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ছবির টাইটেলে ৬টি গোলার আওয়াজ দিয়ে ৬ দফা আন্দোলনের কথা জাতির সামনে তুলে ধরা হয়। ছবিটির পরিসমাপ্তি হয় শত্রু বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বিজয় উল্লাসের মাধ্যমে। একই বছর মুক্তি পায় সুভাষ দত্ত নির্মিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। ছবির গল্প ছিল ব্যতিক্রমী। ছবির অভিনেতা যুদ্ধে যেতে পারে না, কাপুরুষের মতো লক্ষ্য করে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা। একসময় এই কাপুরুষ অভিনেতা বিবেকের দংশনে দংশিত হয়ে বিয়ে করেন হানাদারের হাতে ধর্ষিত এক নারীকে।  

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অশ্লীল প্রদর্শন একাকার হয়ে গেল আনন্দের নির্মিত ‘বাঘা বাঙালি’ (১৯৭২) চলচ্চিত্রে। একই সময়ে মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ও একই পথে যাত্রা করল। পরবর্তীতে জহির রায়হানের অনুপস্থিতিতে আলমগীর কবির নির্মাণ করলেন ‘ধীরে বহে মেঘনা’। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কাহিনী চিত্র হলেও এতে প্রামাণ্য ও ফিকশনের সংমিশ্রণে সফল হন আলমগীর কবির। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও চোরাকারবারিদের সমসাময়িক চিত্র তুলে ধরে নারায়ণ ঘোষ মিতা নির্মাণ করলেন ‘আলোর মিছিল’ (১৯৭৪)। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশে লুটতরাজসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা প্রকাশ পেল খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে নির্মিত আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ (১৯৭৩), চাষী নজরুলের ‘সংগ্রাম’ (১৯৭৪), এম আলীর ‘বাংলার ২৪ বছর’ (১৯৭৪), কবির আনোয়ারের ‘স্লোগান’ (১৯৭৩), আবদুস সামাদের ‘সূর্যগ্রহণ’ (১৯৭৬), ‘সূর্যসংগ্রাম’ (১৯৭৭), শহিদুল হক খানের ‘কলমীলতা’ (১৯৮০), কাজী হায়াতের ‘সিপাহী’ (১৯৯৩), তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫), হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমনি’ (১৯৯৪), ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪), চাষী নজরুলের ‘ধ্র“বতারা’ (২০০৮), শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘লাল সবুজ’, চাষী নজরুলের ‘মেঘের পর মেঘ’ ও তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ‘৭১ এর যীশু (১৯৯২) ও ‘গেরিলা’ (২০১২), মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ (২০১২), শাহজাহান চৌধুরীর ‘আত্মদান’সহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সব ছবি প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরব আর বেদনাগাথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে অমরত্ব দিয়ে যাবে চিরদিন-চিরকাল।

সর্বশেষ খবর