শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গানের কোকিল

গানের কোকিল

সময় পেলেই জানালায় চোখ মেলে দূর অজানায় হারান গানের কোকিল সাবিনা ইয়াসমিন

সাবিনা ইয়াসমিন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী। আধুনিক, দেশাত্মবোধক, চলচ্চিত্র সব গানের অঙ্গনেই রয়েছে তার অবাধ বিচরণ। ষাটের দশক থেকে এখন পর্যন্ত চির সবুজ কণ্ঠের অধিকারী হয়ে আছেন তিনি সুরের জগতে। এই শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন-আলী আফতাব

বাংলা গানের কোকিলকণ্ঠী সাবিনা ইয়াসমিন। গত চার দশকের ও বেশি সময় ধরে কণ্ঠের মিষ্টতা দিয়ে লাখ লাখ শ্রোতার হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন তিনি। তাকে সুরের আকাশ বললেও ভুল হবে না। আকাশের বুকে যেমন থাকে অগণিত তারা তেমনি তার গানের আকাশে আছে অজস্র সুরের ধারা।

১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছোট। সাবিনা ইয়াসমিনের পিতা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার। সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকা সত্তে¡ও সংগীতের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল প্রবল। পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গান গাইতেন। সাবিনা ইয়াসমিনের মা হারমোনিয়াম বাজাতেন।

পড়াশোনাতেও সাবিনা ইয়াসমিন সবসময় ছিলেন বেশ মনোযোগী। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। সাবিনা ইয়াসমিনের আসল নাম ছিল ‘দিলশাদ’, কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদের মেয়ে সাবিনার নামটি তার খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই ‘দিলশাদ’ বাদ দিয়ে তিনি হয়ে গেলেন সাবিনা ইয়াসমিন।

সংগীতের এক একটা তাল-লয়কে ধারণ করে সাবিনা ইয়াসমিন যেমন শ্রোতাদের ভালোবাসায় ঋদ্ধ হন, তেমনি গীতিকার, সুরকাররাও যেন অদ্ভুত একটা আÍতৃপ্তিতে ভোগেন সাবিনা ইয়াসমিন আছেন বলেই। ষাটের দশকে ঢাকার ছবিতে ফেরদৌসী বেগম, আঞ্জুমান আরা এবং ফরিদা ইয়াসমীনের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। সেই আধিপত্যে ভাগ বসিয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন।

১৯৬২ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম প্লে-ব্যাক করেন। ১৯৬৭ সালে আমজাদ হোসেন ও নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে ‘মধু জ্যোৎøার দিপালী’ গানটিতে কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে চলচ্চিত্রের গানে সাবিনা ইয়াসমিনের যাত্রা শুরু।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার শচীন দেব বর্মণ, রাহুল দেব বর্মণ, বাপ্পি লাহিড়ী, পাকিস্তানের গজলসম্রাট মেহেদি হাসান, ভারতের কণ্ঠশিল্পী শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, ভুপেন হাজারিকা, আশা ভোঁসলের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে সাবিনা ইয়াসমিনের।

ছোট বেলায় প্রতিমা ব্যানার্জির মতো গান গাইতে চেষ্টা করতেন। লতা, আশা, নির্মলা মিশ্র, গীতা দত্ত এদের গানও ভালো লাগত।

১৯৭২ সালের কথা। বোম্বেতে গানের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইছেন। শ্রোতা হিসেবে আসেন এসডি বর্মণ, অমিতাভ বচ্চন, জয়া ভাদুড়ী, রাজকুমারসহ আরও অনেকে। হঠাৎ দেখেন লতা মঙ্গেশকর ঢুকছেন। তাকে দেখে ভয় পেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন হারমোনিয়াম বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। তারপর সবাই আবার জোর করে ধরে বসিয়ে দিল। শচীন দেবের অনুরোধে গাইলেন ‘নাইয়ারে নাওয়ের বাদাম তুইলা...’। তখন লতা মঙ্গেশকর উঠে এসে সাবিনা ইয়াসমিনকে আশীর্বাদ করলেন।

 সেই যে ১৯৬২ সালে রেডিওতে ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু করেছিলেন সেই সুরের ধারা এখনো বহমান। শারীরিক অসুস্থতার জন্য মাঝে ছেদ পড়লেও এখন আবার পুরোদমে ফিরে এসেছেন গানের ভুবনে। সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা নাস্তা খেয়েই গলা সাধতে বসে যান। সন্ধ্যার পর আবারও বসে পড়েন হারমোনিয়াম নিয়ে। বিভিন্ন ধাঁচের গানের সুরে ঝালিয়ে নেন কণ্ঠ। মাঝেমধ্যে এসে যোগ দেয় মেয়ে বাঁধন। সেও গান করে। মেয়েকে গানের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেওয়াটা উপভোগই করেন মা।

সাবিনার ভাষ্য, গলা না সাধলে মনটা অস্থির হয়ে যায়। মনে হয়, কী যেন একটা করিনি। ভিনদেশে গেলে সঙ্গে করে ইলেকট্রনিক তানপুরাটা

নিয়ে যান।

১৯৭৫ সালে সত্য সাহা ‘প্রতিনিধি’ চলচ্চিত্রের জন্য সাবিনা ইয়াসমিন ও রুনা লায়লাকে দিয়ে রেকর্ড করান ‘তুমি বড় ভাগ্যবতী’ ডুয়েট গানটি। দারুণ হিট করে। বাংলাদেশের সংগীতের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র সৈয়দ আবদুল হাদীর সঙ্গে অনেক চলচ্চিত্রে দ্বৈতকণ্ঠে গান গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। আবার একসঙ্গে একটি আধুনিক গানের অ্যালবামেও তারা কণ্ঠ দিয়েছিলেন।

বাংলা সংগীতের ধারাকে এক অন্য মাত্রায় যারা নিয়ে গিয়েছেন তাদের মধ্যে সাবিনা ইয়াসমিন অন্যতম। দেশাÍবোধক গানের ক্ষেত্রে সাবিনা ইয়াসমিন বলা যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বি। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫-৪০টি দেশের গান গেয়েছেন।

চলচ্চিত্রের গানে অসামান্য অবদান রাখায় অসংখ্যবার পেয়েছেন তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সাবিনা ইয়াসমিন ৫ বার বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ভারতের ‘বিশ্ব উন্নয়ন সংসদ’ সংগীতের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে এবং ‘সংসদ রতœ’ সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৯০ সালে শেরেবাংলা স্মৃতি পদক। ১৯৯১ সালে উত্তম কুমার পুরস্কার। ১৯৯২ সালে জিয়া স্মৃতি পদক। ১৯৯২ সালে অ্যাস্ট্রোলজি পুরস্কার এবং লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে পান ‘বেস্ট সিঙ্গার’ পুরস্কার। এ ছাড়াও তিনি ভারতে ১৯৯২ সালে বি, এফ, জে, এ কর্তৃক ‘সজনী গো সজনী’ ছায়াছবিতে কণ্ঠদানের জন্য শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে নির্বাচিত হন।

সংগীতের ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সাবিনা ইয়াসমিনকে ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করা হয়।

এখনো সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠের ঝড় মাতাল করে দেয় বাংলার লাখো দর্শক শ্রোতাকে। এখনো মানুষ নতুন জীবনের খোঁজ পায় তার গানে। এখনো বাংলা গানের ধারক-বাহক তিনি। ফেলে আসা দিনগুলো এখনো নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে তাকে। সময় পেলেই জানালায় চোখ মেলে দূর অজানায় হারান সাবিনা ইয়াসমিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর