সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অতিথি বিতর্কে টকশো

শামীম আহমেদ

অতিথি বিতর্কে টকশো

আজকাল টকশোগুলোয় একজন মাঝারি মানের ব্যবসায়ীকে দেখা যায়। তিনি প্রতিটি টকশোতে জ্ঞান দেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে। টকশোতে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে। ঠিক একইভাবে টকশোগুলোতে আরও দেখা যায় নানা ধরনের ব্যবসায়ী, বিজ্ঞাপন সংস্থার বড় কর্মকর্তা, ওষুধ কোম্পানিগুলোর মালিক, দোকানদার ও মাছ ব্যবসায়ীদের। তাদেরও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নানা বিশ্লেষক হিসেবে। তারাও জাতিকে জ্ঞান দেন। কেউ কেউ চাটুকারিতার সীমা ছাড়িয়ে যান। তারপরও তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় টকশোগুলোতে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের জবাব মেলে না। সেদিন বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেন, তাদের দলের নাম ভাঙিয়ে অনেক আইনজীবী, ব্যবসায়ী নানাভাবে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা আসলে দলের কেউ নন। ঠিক একই ধরনের কথা বললেন আওয়ামী লীগের এক সিনিয়র নেতা। তিনি বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য সংখ্যা এক হাজার। তারাও টকশোতে যান দলের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে। অথচ, সমাজে তাদের অন্য পরিচয় আছে। কী রহস্যজনক মধুর কারণে তাদের টকশোতে নেওয়া হয় তা অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো উপস্থাপকের ব্যক্তিগত লেনদেনের কারণে তাদের টকশোগুলোতে নেওয়া হয়। এতে করে টকশোগুলো হয়ে উঠছে বিরক্তিকর ও প্রশ্নবিদ্ধ। এ বিষয়ে বিশিষ্টজনদের মন্তব্য তুলে ধরেছেন- শামীম আহমেদ

ড. আসিফ নজরুল

অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমি টকশোর জম্মলগ্ন থেকে অতিথি হিসেবে যেতাম। বিশেষ করে চ্যানেল আই ও বাংলাভিশনে নিয়মিত অতিথি হিসেবে ডাক পেতাম। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর পৌনে দুই বছরে চ্যানেল আই আমাকে মাত্র দুই দিন ডেকেছে। আর নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপ ফাঁসের পর বাংলাভিশন আমাকে ডাকেই না। অথচ, এর আগে সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডাক পেতাম। ইনডিপেন্ডেন্ট, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর মাসে সর্বোচ্চ একবার কিংবা দুবার ডাকে। তারা জানিয়েও দিয়েছে এর বেশি ডাকা সম্ভব নয়। এসব কেন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে- সবাই তা জানে এবং বোঝে।

এদিকে আবার যাদের আমার সঙ্গে টকশোতে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর কথা তাদের না এনে অন্য কাউকে আনা হয়। একবার অতিথি পরিবর্তন করে প্রচণ্ড সরকার পক্ষের একজনকে আনা হলো। এতে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এভাবে টকশোকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ৫  জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে টকশোকে প্রচারণা যন্ত্র বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আগে বিষয়ভিত্তিক আলোচক আনা হতো। এখন এমন আলোচক আনা হয় যাদের কখনো দেখিনি, নামও শুনিনি, অনেক  সময় আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে তাদের  কোনো সম্পর্কও থাকে না। এ কারণেই টকশোর মান কমে গেছে। টকশো বিকল্প সংসদ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল, সেটা আর এখন নেই। যতটুকু আছে, ততটুকুও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

[অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

মানের কারণে টকশো এখন দর্শকপ্রিয়তা হারাচ্ছে। নাটক, সিনেমা, টকশো- যে কোনো অনুষ্ঠান মানুষ দেখবে কিনা তা নির্ভর করে অনুষ্ঠানটির মেরিটের [মান] ওপর। দর্শকের হাতে এখন রিমোট আছে। ১০০টা বিকল্প চ্যানেল আছে। মান ভালো না হলে চ্যানেল পাল্টে ফেলবে। টকশোতে দর্শক টানতে গেলে বিষয়ভিত্তিক এক্সপার্টদের আনতে হবে। নিজের খাতিরের ব্যবসায়ী, দোকানদার এনে বিশেষজ্ঞ বানিয়ে বসিয়ে দিলে হবে না। তারা তো তাদের উদ্দেশ্য সাধন হয় যাতে, সেভাবেই বক্তব্য দেবেন। টকশোতে বস্তুনিষ্ঠ কথা বলতে হবে। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে হবে। টকশো যেহেতু বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠান, এখানে সরকার ভালো করলে ভালো, খারাপ করলে খারাপ বলতে হবে। আর এটা বলতে পারে এমন লোককেই আমন্ত্রণ জানানো উচিত। তাহলে মান থাকবে।

অসীম কুমার উকিল

[উপ-প্রচার সম্পাদক, আওয়ামী লীগ]

যে ব্যক্তি যে বিষয়ে দায়িত্বে আছেন তাকে সেই বিষয়েই কথা বলতে ডাকা উচিত। যেমন স্থানীয় সরকার নিয়ে কথা বলতে গেলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কথা বলতে গেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট কাউকে ডাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে বরাবরই প্রায় একই ব্যক্তি সব ধরনের আলোচনায় আসেন। কিন্তু একই ব্যক্তি তো সব বিষয়ে পারদর্শী হতে পারে না। এ কারণেই তারা আলোচনার টেবিলে বসে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। টকশোর বিষয় ঠিক করার সময় প্রযোজকদের উচিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী এবং কর্তা ব্যক্তিদেরই আমন্ত্রণ জানানো। অন্যদিকে টকশোতে আলোচক হিসেবে যারা যাবেন তাদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে যাওয়া উচিত। না জেনে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে জাতিকে বিভ্রান্ত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শামসুজ্জামান দুদু

[উপদেষ্টা, বিএনপি চেয়ারপারসন]

যেসব বিষয়ে টকশো হয় ওই বিষয়ের ওপর জানাশোনা ব্যক্তিদের টকশোতে নিয়ে আসা উচিত। এক্ষেত্রে কোনো অজ্ঞ লোক নিয়ে এলে শুধু টকশোর মানই কমে না, জাতি বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। আয়োজকদের এ নিয়ে ভাবা উচিত। উপস্থাপক যখন কোনো একটি পক্ষে অবস্থান নেয় তখন টকশোর মান স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। তখন

ওই টকশোতে ভিন্ন মতের মানুষ যেতে ইতস্তত বোধ করে। এক্ষেত্রে সঞ্চালককে নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। রাজনীতি ছাড়াও অনেক বিষয়ে টকশো হতে পারে। যেমন- খেলাধুলা, সংস্কৃতি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো টকশোতে গুরুত্ব পায় না। যেখানে গণতন্ত্র হুমকির মুখে সেখানে অবশ্য টকশো বা গণমাধ্যমও নানা চাপে থাকে। স্বাধীন দেশে বাক-স্বাধীনতা সবারই থাকতে হবে। না হলে দেশ ও গণতন্ত্র সব ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গোলাম মাওলা রনি

[সাবেক সংসদ সদস্য]

বাংলাদেশে এখন টকশোগুলো পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত। এখানে যারা অতিথি হিসেবে আসছেন তারাও সরকার মনোনীত। এ কারণে দর্শক যাদের টকশোতে অতিথি হিসেবে চাইছেন তাদের পাচ্ছেন না। বাংলাদেশে গত সাত-আট বছরে টকশো একমাত্র অনুষ্ঠান, যেটা ভারতীয় চ্যানেলের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে দর্শক ধরেছিল। মানুষ আগ্রহভরে রাত জেগে টকশো দেখত। এখানে সরকারের ভালো কাজের সঙ্গে সমালোচনাও উঠে আসত। কিন্তু সমালোচনা এড়াতে টকশোর ওপর অলিখিত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এ কারণেই এখন আম বিক্রেতা, কলা বিক্রেতা, মাছ ব্যবসায়ীও টকশোতে গেস্ট হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে জাতিকে রাজনৈতিক জ্ঞান দিচ্ছেন। তাদের বিভিন্ন বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এই ব্যক্তিগুলো টকশোতে এসে নগ্নভাবে সরকারের চাটুকারিতা করছেন। টকশোতে এসব নিম্নমানের লোকের এন্ট্রি সরকারের রুচির জানান দিচ্ছে, চ্যানেলের স্থায়ী ক্ষতি করছে। যে টকশো দেখার জন্য মানুষ কদিন আগেও রাত জেগে বসে থাকত, এখন তারা সবাই ভারতীয় চ্যানেলে ঝুঁকেছে।

এদিকে আবার অনেকে বিএনপি পরিচয়ে টকশোতে আসছেন, কিন্তু তারা সরকারঘেঁষা গ্রুপ। এরা সরকার থেকে নানা ফায়দা নেন, বিএনপি পরিচয় দিয়ে বক্তব্য দেন। এদের কথা মানুষ কেন শুনবে? ‘ইত্যাদি’র পর একমাত্র টকশো ভারতীয় চ্যানেলের অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সব ভণ্ডুল হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর