টিভি নাটকে মুক্তিযুদ্ধের ছায়া বেশ গভীর। আগে নাটকের গল্প এবং নির্মাণে বেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধ প্রেক্ষাপট। কিন্তু বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ বেশ দূরবর্তী কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো উঠে আসে। কিন্তু কেন? এ নিয়ে বিশিষ্টজনদের মন্তব্য তুলে ধরেছেন আলাউদ্দীন মাজিদ ও আলী আফতাব

যুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চমৎকার অনেক গল্প-উপন্যাস রচনা হয়। যা দিয়ে তখন সমৃদ্ধ নাটক নির্মাণ সম্ভব হতো। এখন সেই মানসম্মত লেখা আর কেউ লেখে না। তাই মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবচিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল একটি ঘটনার সার্বিক চিত্র পর্দায় তুলে ধরতে যে আয়োজন দরকার তাতে বড় মাপের অর্থের প্রয়োজন। সেই বাজেট টিভি চ্যানেলগুলো দেয় না। লোকেশনের কথা বলতে গেলে আগের সেই বাড়িঘর আর পরিবেশ এখন নেই। তারপরও শুধু রাস্তা বা গাছতলায় দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের নাটক নির্মাণ সম্ভব। কিন্তু ভালো গল্পের অভাবে তাও করা যাচ্ছে না।

আলী যাকের

যে কোনো বড় ঘটনার তাৎক্ষণিক রিয়েকশন প্রকাশ করতে গেলে তাতে আবেগের প্রাধান্য থাকে বেশি। তাই এগুলোর স্থায়িত্ব অনেক সময় সুদূরপ্রসারী হয় না। আর অনেক দিন পরের রিয়েকশন হয় গবেষণালব্ধ। কারণ ঘটনা তখন হয়ে যায় দূর থেকে দেখা। এতে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। ফলে এগুলো দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে নির্মিত তখন আর এখনকার নাটকের পার্থক্য এখানেই।

মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের অন্যতম জাতীয় চেতনা। তাই বিষয়টি নিয়ে আরও সমৃদ্ধ নাটক নির্মাণ হবে এটিই প্রত্যাশিত।

মামুনুর রশীদ

আমাদের সময়কার মুক্তিযুদ্ধের নাটক আর এখনকার মুক্তিযুদ্ধের নাটকের মধ্যে পর্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। আমরা মুক্তিযুদ্ধের নাটক করেছি মুক্তিযুদ্ধ দেখে। আর এখনকার পরিচালকরা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক করে শুনে। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক একটা দিন এক একটি গল্প হতে পারে। 

ফেরদৌসি মজুমদার

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন নাটক নির্মাণের পরিমাণ কমে গেছে। যা কাম্য নয়। কারণ এই যুদ্ধ হচ্ছে আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে নির্মিত নাটকের আবেদন কখনো কমে না। কারণ এটি হচ্ছে সত্যিকার ঘটনার বাস্তবচিত্র। বিষয়টি নিয়ে ২০ বছর আগে মঞ্চায়িত ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকের কথাই যদি বলি তাহলে দেখা যায় নাটকটির আবেদন এখনো একই। এটি এখনো দর্শকের হƒদয়ে জীবন্ত হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের নাটক মানে সত্যি ঘটনার বাস্তব রূপ। তাই বিষয়টিকে কখনো একঘেয়ে বা বিরক্তিকর মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি নাটক এ ঘটনার একেকটি মাইলফলক। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। পরবর্তী প্রজম্মের জানার জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা তাদের সামনে তুলে ধরতে বেশি পরিমাণে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক নির্মাণ হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

আবুল হায়াত

আগে টিভিতে মুক্তিযুদ্ধের যে নাটক নির্মাণ হতো তাতে যুদ্ধের হুবহু চিত্র দেখতে পেতাম। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকটিই নাটকগুলোতে বেশি প্রাধান্য পায়। যেমন যুদ্ধাপরাধীসহ নানা বিষয়। দুটিই অর্থবোধক ও যথার্থ বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়বস্তু নিয়ে নাটক সব সময়ই নির্মাণ হবে। এটি হচ্ছে বাঙালি জাতির গৌরব আর অহঙ্কারের বিষয়। এ গৌরব আর অহঙ্কার কখনো ম্লান হতে পারে না। নাটক নির্মাণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে নির্মাণ ত্রুটির কারণে এটি যেন বিরক্তিকর হয়ে না দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। কারণ সরকার নাটক নির্মাণে অনুদান দেয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট যেহেতু বিশাল তাই বিষয়টি নিয়ে নাটক নির্মাণে বাজেটও লাগবে বড় অংকের। যা এখন পাওয়া যায় না। ফলে সার্বিক চিত্র ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতে দর্শক দায়সারাগোছের নাটক দেখতে গিয়ে বিরক্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দর্শককে এ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরার সুযোগ দিতে হবে। কারণ নাটকের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ও চেতনাকে চিরঞ্জীব করে রাখতে হবে।

ড. ইনামুল হক

এ সময়ের নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটকগুলো দেখার চেষ্টা করি। অনেকে ভালো করছে। তবে অনেক নাটকের গল্পগুলোর মধ্যে কিছু কমতি আমি লক্ষ্য করি। আমার ওই সময়ে নাটক নির্মাণ করেছি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নানা প্রেক্ষাপট নিয়ে। আমরা মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে দেখে নাটকের গল্প লিখেছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটি নাটক একটি যুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। আমি নতুনদের বলতে চাই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক নির্মাণ করতে হলে আমাদের প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। তবেই আমরা ভালো গল্প নির্মাণ করতে পারব। ভালো নাটকের জন্য গল্প অবশ্যই একটি প্রধান বিষয়। কিন্তু ভালো গল্প নেই।