ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নওয়াজ শরিফের হাতে একবার ‘মুঘল-ই-আজম’-এর ডিভিডি তুলে দিয়েছিলেন। আবার পারভেজ মোশাররফ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন জনপ্রিয় বলিউড তারকা রানী মুখার্জি। এ রকম উদাহরণ হয়তো আর দেখা যাবে না ভবিষ্যতে। কারণ উরি-পরবর্তী ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উত্তেজনার বহরে আজ দু’দেশের সিনে-সম্পর্ক বিলুপ্তির মুখে। মাত্র কয়েকদিন আগেই ভারতীয় প্রযোজক সংস্থা ‘দ্য ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন’ একটি প্রস্তাব পাস করেছে। প্রস্তাবে বলা হয়, বলিউডে পাকিস্তানের শিল্পীদের কাজ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হোক। এর আগে বলিউডের পাকিস্তানি তারকাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন রাজ ঠাকরের নেতৃত্বাধীন কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল মহারাষ্ট্র রাজ্যের নব নির্মাণ সেনা (এমএনএস)। ইতিমধ্যে ভারত ছাড়তে শুরু করেছেন পাকিস্থানি তারকারা। এই দৌড়ে সবার আগে স্ত্রী সাদাফকে নিয়ে ভারত ছেড়েছেন ‘কপূর অ্যান্ড সন্স’ খ্যাত পাক অভিনেতা ফাওয়াদ খান। পাকিস্তানি অভিনেত্রী ও মডেল ভিনা মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভারত থেকে আমি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাক পেয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয় না সেগুলোতে আসা আমার পক্ষে সম্ভব হবে। যে দেশে স্টুডিওর বাইরে থাকা মানুষের কিছু হলেই আমাকে হুমকি দেয় তাদের দেশ ছাড়ার, সেখানে আমি আমার সৃজনশীলতা ধরে রাখতে পারব বলে মনে হয় না। এদিকে ইম্পার সেই প্রস্তাবের প্রতিবাদে পাকিস্তানের সিনেমা হলে ভারতীয় ছবি দেখানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দ্য ডনের খবরে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সিনেমা দেখানো বন্ধের কথা জানিয়েছে পাকিস্তানের করাচির বৃহত্তম সিনেমা হল ‘নুপ্লেক্স সিনেমাস’। পাশাপাশি ‘আট্রিয়াম সিনেমাস’ নামের আরেকটি হলও ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। আট্রিয়াম সরাসরি কিছু না বললেও নুপ্লেক্সের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে নুপ্লেক্স সিনেমাস কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ অন্যদিকে পাকিস্তানি শিল্পীদের ভারতে কাজ করার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ায় নির্মাণাধীন একটি ছবিতে রাহাত ফতেহ আলি খানের গাওয়া গান ভারতীয় শিল্পীকে দিয়ে নতুনভাবে গাওয়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া গুরগাঁওয়ে আতিফ আসলামের কনসার্টও বাতিল করা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস এক খবরে জানায়, পাকিস্তানি শিল্পীদের ভারত ত্যাগের জন্য দেওয়া আল্টিমেটামে বিভক্তি দেখা দিয়েছে বলিউড পাড়ায়। ইম্পার প্রস্তাবের স্বপক্ষে অনেক বলিউড তারকা সরব হলেও এর বিরোধিতা করেছেন সালমন খান, সাইফ আলী খান ও মহেশ ভাটের মতো জাঁদরেল তারকাসহ অনেকেই। এতে সংগীতশিল্পী রাহাত ফতেহ আলীসহ বলিউডের বেশ কিছু পাকিস্তানি নাগরিক তারকা অভিনেতাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে বলিউড। বলিউড সুপারস্টার সালমান খান মন্তব্য করেন, শিল্পীরা সন্ত্রাসবাদী নন। সালমান খানের এই মন্তব্যের পরে বিতর্কে ঝড় উঠেছে বলিউড পাড়ায়। সালমানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন মহেশ ভট্ট, অনুরাগ কাশ্যপ, করণ জোহররা। আবার সরকারের সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়িয়েছে পরিচালক মধুর ভাণ্ডারকর, বর্ষীয়ান অভিনেতা নানা পাটেকর ও গায়ক অভিজিতের মতো তারকারা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য অভিনেতা নানা পাটেকর বলেন সবার আগে দেশ, তারপর পাকিস্তানের শিল্পী। তিনি আরও বলেন দেশের কাছে একজন শিল্পী অনেক ছোট। দেশের জওয়ানরাই আসল হিরো। আবার পাকিস্তানি শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের সমালোচনাও করেন বলিউডের এ অভিনেতা। আর সংগীতশিল্পী অভিজিতের দাবি, সালমান, আমির আর শাহরুখের মতো অভিনেতা পাকিস্তানের শিল্পীদের বলিউডে লালন-পালন করছেন এবং বলিউডে তাদের কাজ পেতে সাহায্য করছেন। এমনকি ‘দালালি’র অভিযোগ এনে এই ‘খান’দের ‘নির্লজ্জ’ বলে টুইটারে সম্বোধন করেন অভিজিৎ। পাশাপাশি করণ জোহর ও মহেশ ভাটের মতো পরিচালককেও তিনি পাকিস্তানের ‘দালাল’ বলে চিহ্নিত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কাছে বলিউডে কর্মরত পাকিস্তানি শিল্পীদের ভিসা বাতিলের আবেদন জানান। তবে এভাবে ভাবতে নারাজ অভিনেতা সাইফ আলী খান। নবাবপুত্রের যুক্তি, আন্তঃদেশীয় সংস্কৃতির আদান-প্রদানে অবশ্যই অনুপ্রেরণা দেওয়া উচিত। এই ইন্ডাস্ট্রি সারা বিশ্বের বিশেষ করে সীমান্তপারের প্রতিভাবানদের জন্য একেবারে উন্মুক্ত। আমরা, শিল্পীরা ভালোবাসা ও শান্তির কথা বলি। তবে, কারা এখানে কাজ করবেন আর কারা করবেন না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে একমাত্র সরকারই। তবে এটা স্পষ্ট যে, সরকারের নির্দেশে ইম্পা এই সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত নড়বে না। ভারতের প্রযোজক সমিতির সহ-সভাপতি চলচ্চিত্র নির্মাতা অশোক পণ্ডিত জানান, চলমান পরিস্থিতির সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানি কলাকুশলীদের ভারতে কাজ করার অনুমতি দেবে না এই সমিতি। এত কিছুর পরেও কিছুটা আশার বাণী ইম্পার সচিব অনিল নাগরাথের কথায়। তিনি বলেন ,পাক শিল্পীরা জঙ্গি নন। কিন্তু যারা এ দেশে এসে টাকা কামাচ্ছেন, তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন।