শিরোনাম
শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নায়করাজের ৫০ বছর

নায়করাজের ৫০ বছর

নায়করাজ রাজ্জাক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতার নাম। তার অভিনয় জীবন চলতি বছর পঞ্চাশের ঘরে পা রাখল।

১৯৬৬ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান তাকে নায়ক করে নির্মাণ করেন ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্র। অসাধারণ অভিনয়শৈলীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এক জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। তার পুরো নাম আবদুর রাজ্জাক। তিনি ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নাকতলায় জন্মগ্রহণ করেন। ষাটের দশক থেকে রুপালি পর্দা কাঁপানো অভিনেতা রাজ্জাক কালক্রমে হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মহান অধিপতি। নায়করাজের চলচ্চিত্র জীবনের ৫০ বছর উপলক্ষে তাকে নিয়ে লিখেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সব কাজ শেষ না করে চলে গেলে আমার আত্মা অতৃপ্ত থেকে যাবে : রাজ্জাক

চলতি বছর উদযাপিত হয় নায়করাজের ৭৫তম জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক বলেন, ‘আমার প্রেম আমার ভালোবাসা আমার সবকিছু অভিনয়, চলচ্চিত্র। এ ছাড়া আমি আর কিছু জানি না, পারি না। আল্লাহ অনেক সুযোগ দিয়েছেন, অনেক কিছু করতে পারতাম। করিনি। স্বপ্ন ছিল কাজ করতে করতে মারা যাব। গত বছরের অসুস্থতায় মরেই গিয়েছিলাম প্রায়। আবার ফিরে এসেছি, আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। যেন কাজ করতে করতে মরে যেতে পারি এই দোয়া আমি সবার কাছে চাই।’ চলচ্চিত্র জীবনের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক বক্তব্যে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন নায়করাজ। রাজ্জাক বলেন, ‘আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি। না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনো দিন আসেনি। ওটা আসেনি বলেই আজকে আমি এতদূর শান্তিতে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘আবার অভিনয় এবং নির্মাণে আসতে চাই আমি। সৃষ্টিকর্তা যেন অন্তত আরেকটিবার আমাকে সেই সুযোগ দেন তার জন্য সবার দোয়া চাইছি। কারণ চলচ্চিত্রকে আমার দেওয়ার আরও অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। সব কাজ শেষ না করে চলে গেলে আমার আত্মা অতৃপ্ত থেকে যাবে।’

 

অভিনয়ে অভিষেক

টালিগঞ্জের ফিল্মপাড়ার কাছেই ছিল রাজ্জাকদের পৈতৃক বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই কানন দেবী, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাসদের দেখে দেখে বড় হয়েছেন। তাদের জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে মনে মনে ভাবতেন ‘একদিন আমি তাদের মতোই বড় অভিনেতা হব।’ টালিগঞ্জের বড় বড় স্টুডিও ছিল তাদের এলাকায়। সেখানে নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতেন তিনি। এভাবেই পীযূষ বোসের নজরে পড়া এবং অভিনয়ে নিয়মিত হওয়া। ঢাকায় আসার পর তিনি যোগাযোগ করেন ঢাকার প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’-এর পরিচালক আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে। তিনিই আবদুর রাজ্জাককে ওই সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ইকবাল ফিল্মসে চাকরি নিয়ে দেন। পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারীর কাজ করতে থাকেন তিনি। সহকারী পরিচালক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি ‘উজালা’। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’, ‘আখেরি স্টেশন’ ও ‘ডাকবাবু’ ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি। এভাবে হঠাৎ সুযোগ আসে নায়ক হওয়ার। জহির রায়হান ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রের নায়ক বানিয়ে দেন তাকে। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয় এবং এতে রাজ্জাকের অভিনয় খুবই প্রশংশিত হয়। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় সরস্বতী পূজায় মঞ্চনাটকে অভিনয়ের জন্য তার গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহী’তে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়করাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা। কলেজ জীবনে মাত্র ২২ বছর বয়সে ‘রতন লাল বাঙালি’ নামক চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান। প্রথমদিকে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয় হন। এরপর চলচ্চিত্র নির্মাতা আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওয়াস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। পরবর্তীতে কার বউ, ডাকবাবু, আখেরি স্টেশন-সহ আরও বেশ কয়টি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন।

১৯৬৬ সালে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে নায়ক হন। নায়ক চরিত্রে প্রথম ছবিতেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। এ পর্যন্ত তিন শতাধিক বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র।

 

প্রথম ছবির অনুভূতি

প্রথম ছবি সম্পর্কে রাজ্জাক বলেন, ‘প্রথম ছবির কথা আজীবন মনে থাকবে। টেনশনও ছিল ভীষণ। মুক্তির দুই-তিন দিন আগে থেকে আমার চোখে কোনো ঘুমই ছিল না। ছবি মুক্তি পেল। আমি বাসায় বসে ভাবছি। এর মধ্যে খবর এলো জহির রায়হান ডাকছেন। ছুটে গেলাম স্টার সিনেমা হলে। দেখলাম লক্ষ্মীন্দররূপী আমাকে দর্শক গ্রহণ করেছে। এর পরের কাহিনী সবারই জানা। তাই নিজের আজকের এ অবস্থানের পেছনে সহশিল্পীদের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। একটা অতৃপ্তি অবশ্য আমার আছে।

আমি জানি, আমার দেশ যেমন ছোট, সামগ্রিক অর্থে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পও অনেক ছোট। কিন্তু গবেষণা করতে তো সমস্যা নেই। আমাদের বয়সের শিল্পীদের নিয়ে কত রকম চ্যালেঞ্জিং চরিত্র সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু আমাদের এখানে তা নেই।’

 

প্রযোজক পরিচালক রাজ্জাক

অভিনয়ের পাশাপাশি রাজ্জাক প্রযোজক পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। গড়ে তোলেন প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন। নির্মাণ করেন আকাঙ্ক্ষা, পাগলা রাজা, জোকার, অনন্ত প্রেম, অভিযান, বদনাম, প্রফেসর, উত্তর ফাল্গুনী, প্রেমশক্তি, ঢাকা ৮৬, জিনের বাদশা, চাপাডাঙ্গার বউ, বাবা কেন চাকর, সৎ ভাই, সন্তান যখন শত্রু, প্রেমের নাম বেদনা, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির, মন দিয়েছি তোমাকে-সহ অসংখ্য ছবি। ১৯৭৭ সালে রাজ্জাক আত্মপ্রকাশ করেন পরিচালক হিসেবে। নির্মাণ করেন অনন্ত প্রেম। তার পরিচালিত অন্যান্য ছবির মধ্যে চাপাডাঙ্গার বউ, বদনাম, বাবা কেন চাকর উল্লেখযোগ্য।

 

বিভিন্ন সংস্থার সদস্য

চলচ্চিত্রশিল্পীদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজ্জাক। এ ছাড়াও তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজ্জাক বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়াও তিনি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করছেন।

 

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বেশ দাপটের সঙ্গেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করে যান রাজ্জাক। এর মধ্য দিয়ে তিনি অর্জন করেন নায়করাজ রাজ্জাক খেতাব। অর্জন করেন একাধিক সম্মাননা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে পাঁচবার সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন রাজ্জাক। ৫০ বছরের চলচ্চিত্রজীবনে তিনি পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা পুরস্কার।

এ ছাড়াও জাতীয় চলচ্চিত্র মেলা ২০০৯-এ চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য রাজ্জাক পরিবারকে সম্মাননা জানানো হয়।

নায়করাজ যে পাঁচ ছবির জন্য নায়ক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান সেগুলো হলো—‘কি যে করি’ (১৯৭৬),‘অশিক্ষিত’ (১৯৭৮),‘বড় ভালো লোক ছিল’ (১৯৮২), ‘চন্দ্রনাথ’ (১৯৮৪) এবং ‘যোগাযোগ’ (১৯৮৮)।

২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে নায়করাজকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।

 

এক নজরে রাজ্জাক

প্রকৃত নাম : আবদুর রাজ্জাক।

বাবা-মা : আকবর হোসেন ও নিনারুন্নেসা।

জন্ম : ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি। কলকাতার টালিগঞ্জে।

বিয়ে : ১৯ বছর বয়সে ১৯৬২ সালে বিয়ে করেন খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীকে।

সন্তান : তিন পুত্র ও দুই কন্যা।

বাংলাদেশে আগমন : ১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসেন।

অভিনয় জীবন : স্কুলে পড়ার সময় ‘বিদ্রোহী’ নাটকে, কলেজ জীবনে ‘রতন লাল বাঙালি’ ছবিতে তার প্রথম অভিনয়। ১৯৫৯ সালে বোম্বের ফিল্মালয়ে ভর্তি হন। এরপর কলকাতার ‘পংকতিলক’ এবং ‘শিলালিপি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়। ১৯৬৪ সাল থেকে ঢাকার ছবিতে অভিনয়।

প্রথম ছবি [নায়ক] : ১৯৬৬ জহির রায়হানের ‘বেহুলা’।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর