বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভালো নেই রূপবান সুজাতা

আলাউদ্দীন মাজিদ

ভালো নেই রূপবান সুজাতা

‘আমি সাহায্যের জন্য কারও কাছে হাত পাততে চাই না, কাজ চাই। মাসে যদি ১৫ দিন কাজ পাই তাহলে সন্তান আর নাতিদের নিয়ে বেঁচে যাই।’ অশ্রুসজল চোখ আর কান্নায় জড়িয়ে আসা কণ্ঠে এভাবেই নিজের অসহায় জীবনের কথা বলছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের রূপবান খ্যাত নায়িকা সুজাতা।

জনপ্রিয় এ অভিনেত্রী এখন ভালো নেই। পশ্চিম রামপুরার  মহানগর আবাসিকের ছোট্ট একটি ভাড়া বাসায় ছেলে ফয়সাল আজিম আর দুই নাতি ফারদিন আজিম ও আবিয়াজ আজিমকে নিয়ে চরম আর্থিক সংকটে কাটছে তার দিন।

সুজাতা বলেন আমার বড় নাতি ‘ও’ লেভেলে পড়ছে। জানুয়ারিতে তার পরীক্ষা। অর্থের অভাবে এখনো পরীক্ষার ফিস জমা দিতে পারিনি। জানি না ও পরীক্ষা দিতে পারবে কিনা। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ঘর ভাড়া জমে গেছে অনেক। মান সম্মান নিয়ে কীভাবে বাঁচব জানি না।

হাটখোলার নিজের বাড়িটি ২০০৩ সালে বিক্রি করে স্বামী অভিনেতা আজিমের চিকিৎসা করিয়েছি। এখন আমি নিঃস্ব। শিল্পী ঐক্যজোটের উপদেষ্টা অভিনেতা ডি এ তায়েব আর জোটের আহ্বায়ক নাট্যনির্মাতা জিএম সৈকত আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদের নাটকে কাজ করব। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। শুধু এ দুইজনের নাটকে কাজ করে তো আর চলতে পারব না তাই সবার কাছে অনুরোধ- আমাকে কাজ দিন। চলচ্চিত্র কিংবা নাটক যাই হোক।

১৯৬৫ সালে ‘রূপবান’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর সুজাতার নাম ছড়িয়ে পড়ে। রূপবান কন্যাকে সরাসরি দেখার জন্য লোকজন অস্থির হয়ে পড়েছিল। সুজাতা ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন শীর্ষ নায়িকাদের একজন।

জীবনের পথে আজিম-সুজাতা চলতে শুরু করেছিলেন ১৯৬৫ সালে ‘ডাকবাবু’ ছবিতে অভিনয়ের সময়। আমৃত্যু সে সম্পর্ক ছিল পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ। আজিম মারা গেছে ২০০৩ সালে। একমাত্র পুত্র ফয়সাল ছোটখাটো ব্যবসা করে। তার রোজগার দিয়ে সংসার চলে না। সুজাতা বলেন, আমার বাবা ছিলেন জমিদার আর শ্বশুর জজ। আমি সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। মানুষের কাছে সাহায্যের হাত পেতে চলতে চাই না। শুধু কাজ চাই। কাজ দিয়ে আমাকে ও আমার ছেলে-নাতিদের বাঁচান।

শিল্পী ঐক্যজোট সুজাতার অসহায় অবস্থায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

অভিনেতা ডি এ তায়েব বলেন, শিল্পী ঐক্যজোটের মাধ্যমে তাকে কাজ দিয়ে আবার দাঁড় করাতে পারব বলে আমার বিশ্বাস। আমি তার অভিনয়ের ভক্ত। একসময় তার স্বর্ণযুগ গেছে। আজ তাকে এভাবে দেখে আমি ব্যথিত। আমি চাই সরকারসহ সবাই যেন তার পাশে এসে দাঁড়ায়। সুজাতা যেন মান সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারেন সেই চেষ্টা সবাই মিলে করতে চাই। শিল্পী ঐক্যজোটের আহ্বায়ক দর্শকপ্রিয় নাটক নির্মাতা জিএম সৈকত বলেন, সুজাতার মতো সিনিয়র শিল্পীদের কাজের জায়গা ও মূল্যায়ন কমে গেছে বলে তারা আজ দুঃসময়ের মুখোমুখি। আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে সুজাতার মতো বরেণ্য শিল্পীদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে চাই। যেন তারা মান সম্মান নিয়ে সচ্ছলভাবে বাঁচতে পারেন। সুজাতার জন্ম কুষ্টিয়া শহরে। তার প্রকৃত নাম  তন্দ্রা মজুমদার। কুষ্টিয়ায় এক সময় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হলে তারা কুষ্টিয়া ছেড়ে চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে নাটক ও থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন তন্দ্রা। সেসময় নারায়ণ চক্রবর্তী, নাজমুল হুদা বাচ্চু, আমজাদ হোসেনসহ আরও অনেকের নির্দেশনায় মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন তিনি।

একসময় আমজাদ হোসেনই পরিচালক সালাহউদ্দিনের সঙ্গে ‘তন্দ্রা’কে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তন্দ্রা নাম পরিবর্তন করে সালাউদ্দিন ১৯৬৩ সালে তার পরিচালিত ‘ধারাপাত’ ছবিতে সহ-নায়িকা হিসেবে নিয়ে নাম রাখেন ‘সুজাতা’। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০টি ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন সুজাতা। সব মিলিয়ে তিনশ ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। সুজাতা পরিচালিত একমাত্র চলচ্চিত্র ‘অর্পণ’। সুজাতা-আজিমের নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থাগুলো হচ্ছে- ‘সুজাতা প্রোডাকশন্স’, ‘এস এ ফিল্মস’ ও ‘সুফল কথাচিত্র’। এ তিনটি প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে নির্মিত হয়েছে ‘চেনা অচেনা’, ‘টাকার খেলা’, ‘প্রতিনিধি’, ‘অর্পণ’, ‘রূপবানের রূপকথা’, ‘বদলা’, ‘রং বেরং’, ‘এখানে আকাশ নীল’ ইত্যাদি। ২০০৩ সালে স্বামী আজিম মারা যাওয়ার পর কিছুদিন বিরতি দিয়ে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টিভি নাটকেও নিয়মিত অভিনয় করেন তিনি। একসময় চলচ্চিত্রের অবস্থা প্রতিকূল হয়ে পড়লে এবং টিভি নাটকে কাজ তেমন না পাওয়ায় ধীরে ধীরে আর্থিক অসচ্ছলতার মুখে পড়েন এ কিংবদন্তি অভিনেত্রী। সুজাতা বলেন, ‘আমি জানি দর্শক আজও আমাকে মনে রেখেছেন, এখনো তারা আমাকে ভালোবাসেন, সম্মান করেন। এটা বিশাল এক প্রাপ্তি। বাকি জীবনটা এ ভালোবাসা নিয়ে সুখে শান্তিতে সচ্ছলভাবে বাঁচতে চাই’।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর