শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মঞ্চ ফের জেগে উঠেছে রিজওয়ানে

পান্থ আফজাল

মঞ্চ ফের জেগে উঠেছে রিজওয়ানে

স্বাধীনতা-পরবর্তী নাট্য-আন্দোলনের পথ ধরে আমাদের নাটক নতুন উদ্যমতায় প্রবাহিত হয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, সত্তর থেকে নব্বই দশকে আমরা শিল্পসমৃদ্ধ ও হৃদয় স্পর্শক যেসব প্রযোজনা পেয়েছি পরবর্তী সময়ে সেই ধারা বজায় থাকেনি। তবে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদের মতো বিচক্ষণ নির্দেশকের মসৃণ পথ ধরে আমাদের নাটক পেয়েছে আজাদ আবুল কালাম, অনন্ত হীরা, সুভাশিষ সিনহা এমনকি সুদীপ চক্রবর্তীর মতো এ প্রজন্মের তারুণ্যদীপ্ত দুরন্ত নাট্য-নির্মাতাদের। তবে এ সময়ে আলোচনায় তেমন করে কোনো মঞ্চনাটক বা নাট্যকার না থাকলেও কিছু ডেডিকেটেড ভালো করছেন। আমাদের অভিনয়ে, নির্মাণে, নেপথ্যে অর্থাৎ কলা-কৌশলীর জায়গাতেও আধুনিকায়নের স্পর্শে পরিবর্তন এসেছে। সম্প্রতি বাতিঘরের প্রযোজনা ‘অলিখিত উপাখ্যান’, ‘ঊর্নাজাল’, ম্যাড থেটারের ‘নদ্দিউ নতিম’, শিল্পকলার ‘মুল্লুক’, মনিপুরী থিয়েটারের ‘লেইমা’, ‘কহে বীরঙ্গনা’, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ‘গহর বাদশা ও বানেছা পরী’, প্রাঙ্গণে মোরের ‘কনডেমড সেল’, প্রাচ্যনাটের ‘বনমানুষ’, ‘ট্র্যাজেডি পলাশবাড়ী’ থিয়েটার প্রেমীদের কিছুটা স্বস্তি দিলেও বেশির ভাগ প্রযোজনা দর্শক তেমন টানতে পারছে না। এমনিতে দুই ঈদের আগে ও পরে প্রায় দুই সপ্তাহ কোনো নাটকের দেখা মেলে না ঢাকার মঞ্চে। তবে এবার ঘটেছে ব্যতিক্রম। ঈদ আনন্দে যুক্ত হয়েছে মঞ্চনাটক। ১ সেপ্টেম্বর থেকে একটানা চলে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় মঞ্চনাটক ‘রিজওয়ান’। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান নিয়ে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে নাটবাংলার এ নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রতিদিন দুটি করে শো অনুষ্ঠিত হয়। নাটকটি নিয়ে সবার আগ্রহের প্রধান কারণ ছিল বিশিষ্ট নাট্যজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। প্রায় দুই যুগ পরে তিনি আমাদের মূলধারার মঞ্চে নতুন একটি নাটকের নির্দেশনা দিলেন। রিজওয়ান নাটকটি নির্মিত হয়েছে কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত মার্কিন কবি আগা শহিদ আলির ‘দ্য কান্ট্রি উইদাউট এ পোস্ট অফিস’ অবলম্বনে। ভাষান্তর করেছেন ঋদ্ধিবেশ ভট্টাচার্য। নাট্যকার অভিষেক মজুমদার। নাটকে রিজওয়ান ও ফাতিমা নামের দুই ভাইবোনের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে। আগা শহিদ আলি কাশ্মীরি প্রেক্ষাপটে কাহিনীর বর্ণনা করলেও তা সন্দেহাতীতভাবে সন্ত্রাস ও অমানবিক বৈষম্যের শিকার হওয়া পৃথিবীর সব বিপর্যস্ত মানুষের গল্প হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে সুযোগসন্ধানী সাম্রাজ্যবাদী ক্রীড়নকদের সৃষ্ট আগ্রাসন, যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতায় বিধ্বস্ত নারী ও শিশুদের জীবনের করুণ আলেখ্য। তবে সন্দেহাতীতভাবে ঢাকার মঞ্চনাটকের জন্য ‘রিজওয়ান’ এক অভিনব ঘটনা! নাটকটি দেখতে শিল্পকলা ব্যস্ত পাড়ায় পরিণত হয়। কোনো মঞ্চনাটক নিয়ে এর আগে এত উন্মাদনা আর দেখা যায়নি। সব শোই ছিল পুরো হাউসফুল। আর হবেই-বা না কেন? এটা তো সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনা! এই মঞ্চপাগল বা খ্যাপাটে নির্দেশক প্রায় দুই যুগ পর ঢাকার মঞ্চে নির্দেশনা দিলেন। এ নাটকের মাধ্যমে এই বাংলাদেশে কোনো নাট্য-আয়োজনে একটিমাত্র প্রযোজনার টানা ১৯টি পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হয় একটি উত্সবে। জানা যায়, প্রথম দিকে হলের আসন সংখ্যা ২২০টি থাকলেও পরে দর্শকদের চাপ সামলানোর জন্য সিঁড়ির জায়গাতেও আসন বসানো হয়েছিল। এরপর আর এ নাটকের মঞ্চায়ন করা হবে না বলে আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া হয়। ঢাকা শহরে মঞ্চনাটক হয়। ছোট-বড় নাটকের দল তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় নিয়ে আসে একেকটি নাটক। ধরাবাঁধা গুটিকয় দর্শক সেই নাটক দেখতে যান। আলোচনা হয় আরও কম পরিসরে। সেই হিসেবে এবার পুরো ব্যতিক্রম ঘটে গেল রিজওয়ানাকে নিয়ে। মঞ্চনাটক দেখতে উপচে পড়া মানুষের ভিড়, টিকিট নেই। একদিন আগে সব টিকিট বুকড। এ কখনো ঢাকার মঞ্চনাটকের নিয়মিত চিত্র নয়। শিল্পকলার প্রাঙ্গণে ঢুকতেই এত মানুষের ভিড়, টিকিটের হাহাকার মনে আশা জাগায়। মনে হয় মঞ্চনাটকের দিন বুঝি ফিরে এলো এ দেশে! অনেকদিন ধরে ফেসবুকে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘রিজওয়ান’। সৈয়দ জামিল আহমেদ আমাদের দেশে প্রচলিত থিয়েটার ভাবনাকে, থিয়েটার উপস্থাপন রীতিকে বারবার চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রচলিত ফর্ম ও প্রয়োগরীতি তিনি বারবার ভেঙেচুরে নির্মাণ করেছেন তার থিয়েটার। প্রতিবারই যেমন প্রশংসিত হয়েছে তার কাজ, তেমনি সমালোচনাও জুটেছে। বিষাদ সিন্ধু, ‘সঙ ভঙ চঙ’, ‘বেহুলার ভাসান’ তার আলোচিত প্রযোজনা। আর রিজওয়ান-এ এসে তা যেন চূড়ান্ত মহিমায় উদ্ভাসিত হলো। আমাদের থিয়েটার কতটা এগিয়েছে, একটা নাটকে কতটা শ্রম, মেধা, সৃজনশীলতা মিশে থাকে সেটা ‘রিজওয়ান’ না দেখলে বোঝা যাবে কীভাবে? রিজওয়ান-এর আলোচনা শুধু নাট্যশালায় না, ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও।

নাট্যকর্মী থেকে সিনেমা, সংগীতাঙ্গনের লোকজন ভিড় করছেন রিজওয়ান দেখতে। এতেই কি বোঝা যায় না, ঢাকার মঞ্চপাড়ায় মোড় ঘোরানোর পেছনে ‘রিজওয়ান’ অন্যরকম ভূমিকা পালন করছে? যে সময়ে আমাদের বড় পরিকল্পনা, বড় শ্রম, বড় স্বপ্ন মুখথুবড়ে পড়ছে, সেই দুঃসময়ে একজন জামিল আহমেদ কীভাবে একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই ‘রিজওয়ান’।

আমাদের সংঘনাট্য চর্চায় যেখানে আমরা সব কিছু সীমিত হয়ে আসতে দেখছি, সেখানে একজন সৈয়দ জামিল আর তার রিজওয়ান ঘুণে-ধরা গোষ্ঠীকে জোগাচ্ছে আশার সঞ্চার।

সর্বশেষ খবর