রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাওয়া কালজয়ী যত ছবি

আইন মানায় ফিল্ম আর্কাইভের শিথিলতা

হারিয়ে যাওয়া কালজয়ী যত ছবি

চলচ্চিত্র সংরক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফিল্ম আর্কাইভ। আর্কাইভে ছবি জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও অনেক নির্মাতাই তা মানেন না। আর আর্কাইভও তাদের ছবি জমা দিতে বাধ্য করে না। ব্যবস্থা গ্রহণে শৈথিল্যের কারণে কালজয়ী অনেক ছবিই হারিয়ে গেছে। এ আইনের আওতায় আজ পর্যন্ত আনা হয়নি সংশ্লিষ্ট কোনো নির্মাতাকে। এ বিষয়ে লিখেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

   

যেসব ছবি কখনই আর দেখা যাবে না

নির্মাতার অসচেতনতা ও ফিল্ম আর্কাইভ কঠোর না হওয়ায় প্রচুর ছবি জমা হয়নি আর্কাইভে। এতে বহু কালজয়ী ছবি চিরতরে হারিয়ে গেছে। এমন ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে— চান্দা, চাঁদনী, রাজধানীর বুকে, দ্য রেইন, কসাই, অংশীদার, অনন্ত প্রেম, জিঘাংসা, আকাশ আর মাটি, রাজা এলো শহরে, মাটির পাহাড় প্রভৃতি। এহতেশাম পরিচালিত ‘চাঁদনী’ ছবির প্রযোজক ছিলেন বেক্সিমকোর এক  পরিচালক। তার অজান্তা কথাচিত্র ছবিটি আর্কাইভে জমা দেয়নি। নায়করাজ রাজ্জাক তার নির্মিত ছবিগুলো শেখ ফরিদ নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেওয়ায় রাজ্জাকের রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের কোনো ছবির ৩৫ মিমি রিল আর্কাইভে জমা পড়েনি। শাবানার এস এস প্রোডাকশনের কোনো ছবিও জমা পড়েনি আর্কাইভে। সাইফুল আজম কাশেমও তার মেট্রো ফিল্মসের সোহাগ, বৌরানী, ঘর সংসারসহ কোনো ছবি জমা দেননি। ইলিয়াস কাঞ্চন প্রযোজিত কোনো ছবি নেই আর্কাইভে। নায়ক আলমগীর জমা দেননি তার বৌমা, মায়ের দোয়াসহ নিজের নির্মিত কোনো ছবি। আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড জমা দেয়নি কেয়ামত থেকে কেয়ামত, স্বজন, আমার ঘর আমার বেহেশত, অগ্নি সাক্ষী। মুস্তাফিজের কালজয়ী ছবি ‘তালাশ’র প্রিন্ট নেই আর্কাইভে। এস এম শফী তার বিখ্যাত ‘দি রেইন’ ছবিটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন পাঁচবিবি সিনেমা হলের মালিক ইদরিসের কাছে। তিনি ছবিটি আর্কাইভে জমা দেননি। এফডিসিতে এর একটি নেগেটিভ থাকলেও সংরক্ষণের অভাবে তা নষ্ট হয়ে যায়। দিলীপ বিশ্বাসের ‘অপেক্ষা’ আর গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছাড়া তাদের আর কোনো ছবি নেই আর্কাইভে। জেড এ ফিল্মস, পারভেজ ফিল্মস, ছায়াবাণী, নারায়ণ ঘোষ মিতার রূপবাণী, জসিমের জেম্বস প্রোডাকশনেরও কোনো ছবি নেই ফিল্ম আর্কাইভে। গুলিস্তান বিল্ডিংয়ে প্রযোজনা সংস্থার অফিস ছিল। নব্বই-এর দশকের অগ্নিকাণ্ডে অসংখ্য কালজয়ী ছবি পুড়ে যায় সেখানে। ফিল্ম আর্কাইভে জমা থাকলে ধ্বংস হয়ে যেত না ছবিগুলো।

 

২৭ বছর পর উদ্ধার হলো ‘সুজন সখী’

একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কবরী-ফারুক অভিনীত সত্তরের দশকের সাড়া জাগানো সাদাকালো চলচ্চিত্র সুজন সখী ছবির ৩৫ মি.মি. একটি প্রিন্ট চলতি বছরের ১১ জুন উদ্ধার করে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। আর্কাইভের চলচ্চিত্র সংগ্রাহক মো. ফখরুল আলম ছবিটির একটি প্রিন্ট উদ্ধার করেন মগবাজার এলাকার একটি বাড়ি থেকে। ১৯৭৫ সালের ১০ অক্টোবর মুক্তিপ্রাপ্ত গ্রামীণ গল্পে প্রমোদকার গোষ্ঠী নির্মিত জনতা প্রডাকশনের এ ছবিটি ১৯৯০-৯১ সালের দিকে চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমানের ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার সৌমেন বাবু বিক্রি করে দেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক মিয়া আলাউদ্দিনের কাছে। মিয়া আলাউদ্দিনের কাছ থেকে সুজন সখী ছবির একটি মাত্র কপি বেটাকম ক্যাসেটে ক্রয় করে রাখেন মধুমিতা মুভিজের মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ। একসময় তার কাছ থেকে ছবিটি হারিয়ে যায়। ফিল্ম আর্কাইভে সুজন সখী ছবির কোনো সেলুলয়েড প্রিন্টের কপি না থাকায় দীর্ঘদিন থেকে এটি উদ্ধারের চেষ্টা চলে।

 

ফিল্ম আর্কাইভ কেন

চলচ্চিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে বিশ্বের সব দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় ফিল্ম আর্কাইভ বা ফিল্ম মিউজিয়াম।  ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশেও ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠিত হয়। ছবি নির্মাণের পর নির্মাতার দায়িত্ব হচ্ছে ছবির একটি কপি আর্কাইভে জমা দেওয়া। যাতে ছবিটি সংরক্ষিত থাকে। অনেক নির্মাতাই এ নিয়ম মানেন না। ফলে হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে অনেক ছবি। ছবি জমাদান বাধ্যতামূলক করে সরকার আইন প্রণয়ন করে। এ আইন অমান্যে শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনো নির্মাতা শাস্তি পাননি। শুধু নোটিস প্রদানের মধ্যেই আইনি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

 

ফিল্ম আর্কাইভের আইন

নির্মাতাদের মধ্যে ছবি জমা দেওয়ার উদাসীনতা দেখা দেওয়ায় প্রচুর ছবি হারিয়ে গেলে আইন করে সরকার। ২০০৫ সালের কপিরাইট অ্যাক্টে বলা আছে, ছবি নির্মাণের পর সংরক্ষণের জন্য অবশ্যই সেই ছবির একটি কপি নির্মাতাকে ফিল্ম আর্কাইভে জমা দিতে হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট নির্মাতার দুই বছরের জেল এবং একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হবে। ফিল্ম সেন্সর বোর্ডকে বলা হয়েছে, ছবি সেন্সরের পর নির্মাতাকে আর্কাইভে ছবির কপি জমা দেওয়ার জন্য বলা হবে এবং ওই নির্মাতা আগে কোনো ছবি নির্মাণ করে থাকলে তা আর্কাইভে জমা দেওয়া হয়েছে মর্মে কাগজপত্র দেখাতে হবে, যা সঠিকভাবে কখনই মানা হয় না এবং সংশ্লিষ্টরা অজানা কারণে শাস্তি পান না।

 

ফিল্ম আর্কাইভ-সেন্সর বোর্ডের বক্তব্য

ফিল্ম আর্কাইভ সূত্রে জানা গেছে, যেসব নির্মাতা ছবি জমা দেন না তাদের কাছে একাধিকবার চিঠি দিয়ে ও সরাসরি লোক পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। ২০০৫ সালের আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে যারা এ পর্যন্ত ছবি জমা দেননি তাদের তালিকা করা হচ্ছে। অনেকে ছবি জমা দেওয়া শুরুও করেছেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের জন্য সেন্সর বোর্ডকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে যারা আইন মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

কেন নির্মাতারা এখন ছবি জমা দেন না

২০১৩ সালে ডিজিটাল ফরমেটে ছবি নির্মাণ শুরু হলে কোনো নির্মাতাই আর্কাইভে ছবি জমা দিতে আগ্রহ দেখাননি। জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ বলেন, আর্কাইভ যে ফরমেটে ছবি জমা দিতে বলে অর্থাৎ হার্ড ড্রাইভ বা হার্ড ডিস্ক তা নিরাপদ নয়। বলা যায় উন্মুক্ত এই পদ্ধতিতে ছবি জমা দিলে তা কপি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিহাব শাহীন বলেন, আসলে ছবি জমা দেওয়ার নিয়ম এবং এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা কেউ দেন না বলেই এটি আর হয়ে ওঠে না।

সর্বশেষ খবর