বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কোন পথে ঢাকাই ছবি

আলাউদ্দীন মাজিদ

কোন পথে ঢাকাই ছবি

কোন পথে এখন ঢাকাই ছবি। প্রযোজক সমিতি দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর, যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ স্থগিত, ছবির অভাবে সিনেমা হল বন্ধের আশঙ্কা, স্বল্প বাজেটের স্থানীয় ছবি চলছে না, ভারতীয় ছবি দর্শক দেখছে না, বয়কট বহিষ্কারের সমাধান হচ্ছে না। এমন অনেক কারণে ঢাকাই ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত চলচ্চিত্রকার ও চলচ্চিত্র বোদ্ধারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ে আর কোনো আশা দেখছি না। দেশীয় চলচ্চিত্র এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এটি হচ্ছে একটি সৃষ্টিশীল মাধ্যম। সৃষ্টিশীল কর্মে যে পরিবেশ থাকার প্রয়োজন তা এখন নেই। পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি, দলাদলি থেকে শুরু করে নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড শিল্পটিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম চলচ্চিত্রশিল্পকে এভাবে বিতর্কিত ও অনিশ্চিত করা কারও কাম্য নয়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ বলেন, চলচ্চিত্রের বর্তমান নেতিবাচক অবস্থা খুবই দুঃখজনক। প্রযুক্তিগত, নির্মাণগত, প্রতিভাগত সংকটের সঙ্গে এখন ঐক্যের যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে এই শিল্পের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে। নানা শিল্পকলার সমন্বয় আর বিভিন্ন উপাদান ও আবহে তৈরি হয় চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র হলো একটি যৌগিক শিল্প। এর পরিবেশও যৌগিক হতে হবে। বর্তমান নানা অনৈক্য এই শিল্পের অধঃপতন ডেকে আনছে। এই অবস্থার দ্রুত সমাধান দরকার। না হলে চলচ্চিত্রের জন্য এটি হবে একটি আত্মঘাতী কাজ। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদ বলেন, সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে কনটেন্ট দরকার। তা কোথায়? স্থানীয়ভাবে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে মানসম্মত হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে সিনেমা হলের যে সংখ্যা রয়েছে তাতে এক কোটি টাকা ব্যয় করে ছবি নির্মাণ করলেও লগ্নিকৃত অর্থ তুলে আনা অসম্ভব। যৌথ প্রযোজনায় ছবিতে উন্নত বাজেট থাকায় কারিগরি ও শৈল্পিক মান বজায় রাখা যায়। যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ না হলে অবস্থা হবে ভয়াবহ। ছবির অভাবে আগামী বছরেই দেশের অধিকাংশ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাবে। এফডিসি সূত্রে জানা গেছে, কয়েকবছর ধরে ছবি এন্ট্রির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম চৌধুরী উদ্বেগ জানিয়ে বলেন,  স্থানীয়ভাবে ছবি নির্মাণ কমেছে, যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে নানা টালবাহানা চলছে, চলচ্চিত্র বিনিময়ের ক্ষেত্রে নানা শর্ত আরোপে স্বাভাবিক আমদানি রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় কম বাজেটের ছবি মানহীন হওয়ায় দর্শক এখন যৌথ প্রযোজনার ছবি দেখতেই আগ্রহী। নীতিমালা না মানার অজুহাতে এই আয়োজনের ছবি নির্মাণ ব্যাহত করা হচ্ছে। বিনিময়ের জন্য গঠিত কমিটি যে ছবি আগে সেন্সর ছাড়পত্র পেয়ে গেছে তার আবার মান যাচাই করবে কেন? কয়েকটি সিনেমা হলের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কলকাতার ছবি এদেশের দর্শক দেখে না। স্থানীয় ছবির বাজেট কম থাকে বলে মানের অভাবে তা চলে না। একমাত্র ব্যবসা হয় জাজ মাল্টিমিডিয়ার যৌথ আয়োজনের ছবিগুলো। জাজের ছবির বাজেট ভালো বলে মানও ভালো হয়। দেশীয় শিল্পের উন্নয়ন করতে গিয়ে ঈর্ষান্বিত কিছু মহল জাজের ভালো কাজে বাধার সৃষ্টি করেছে। জাজ শুধু ভালো ছবিই উপহার দিচ্ছে না। ঢাকাই ছবির শিল্পী সংকটে বাপ্পী, মাহী, নুসরাত, জলি, রোশানের মতো শিল্পী উপহার দিয়ে শিল্পী সংকটও দূর করেছে এবং বাংলাদেশি ছবি ও শিল্পীদের আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। জাজকে দেশীয় চলচ্চিত্রের উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সিনেমা হল মালিকরা বলেন, নভেম্বরে চালানোর মতো কোনো ছবি নেই। ডিসেম্বরে মাত্র দুটি ছবি মুক্তি পেতে পারে। আগামী বছরের অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। এটি এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য সত্যিই অশনি সংকেত। যৌথ প্রযোজনার নতুন নীতিমালা তৈরি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রযোজক বলেন, ছবি নির্মাণে লগ্নি করেন প্রযোজক। তাই নীতিমালা তৈরির কমিটিতে প্রযোজককেই থাকতে হবে। প্রযোজকই বলতে পারবেন কীভাবে নীতিমালা করলে সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে একটি যথাযথ ছবি নির্মাণ করা সম্ভব এবং এক্ষেত্রে করণীয় কী? কিন্তু গঠিত কমিটিতে কোনো প্রযোজক নেই। প্রযোজকবিহীন কমিটির প্রস্তাবনায় নতুন নীতিমালা তৈরির অর্থ হচ্ছে যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ বন্ধের পাঁয়তারা করা। একই সঙ্গে ছবির অভাবে সিনেমা হল বন্ধ করে এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়া। সত্যিই এটি একটি দেশের জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জার বিষয়।

চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ বলেন, চলচ্চিত্র শিল্পে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। যারা চলচ্চিত্রপ্রেমী, সিনিয়র চলচ্চিত্রকার, বিনোদন সাংবাদিক এবং পত্রিকার সম্পাদক, তাদের কর্তব্য এই শিল্প রক্ষায় অনতিবিলম্বে এগিয়ে আসা। তারা যদি দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে চলচ্চিত্র শিল্পের এই বিভাজনের জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদেরই দায়ী করবে। চলচ্চিত্রের মতো একটি প্রধান গণমাধ্যমে মারামারি, হাতাহাতি অত্যন্ত নিন্দনীয় ও লজ্জাজনক কাজ। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই দুরাবস্থার অবসান হওয়া উচিত। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, চলচ্চিত্র শিল্পে নানা সমস্যা চলছে সত্যি, তবে আমি হতাশ নই। সবাই যদি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ও আন্তরিকভাবে কাজ করে তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। প্রযোজক সমিতির অচলাবস্থার কারণে আমরা পরিচালকসহ চলচ্চিত্রের মানুষরা নানা সমস্যার মুখে পড়ছি। তারা যদি শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান না করে তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তারপরেও চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশাবাদী। জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ বলেন, দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে আমি কাজ করছি। অথচ নানা ইস্যু তৈরি করে আমার কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণে প্রিভিউ বোর্ডের যথাযথ অনুমতি নিয়েই ছবি নির্মাণ করি। তাহলে পরে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা বা সেন্সর না করা উদ্দেশ্যমূলক নয় কি? তাছাড়া এতবছরেও সিনেমা হলে কেউ ডিজিটাল প্রজেক্টর স্থাপন করেনি কেন? আমি আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে কী অন্যায় করেছি। আমি যখন মেশিন বসিয়েছি তাহলে সেই খরচ বা ভাড়া আমাকে নিতেই হবে। এখানে মনোপলি ব্যবসার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর