নাট্যান্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশে মঞ্চনাটকে সফলতা এলেও এই সময়ে এসে দর্শক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারণ এই দর্শক সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য যেমন ভালো পাণ্ডুলিপি, নাট্যকার, নির্দেশক বা মহড়া কক্ষ জরুরি হয়ে পড়েছে তারচেয়েও নাট্য প্রদর্শনীর জন্য আগে প্রয়োজন মিলনায়তন। ইদানীং নাট্য প্রদর্শনীর জন্য মিলনায়তন সংকট চরম আকার ধারণ করছে। মিলনায়তন সংকট ও তার থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে লিখেছেন— পান্থ আফজাল
মঞ্চনাটক আমাদের সংস্কৃতির রুচিবোধকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নাট্য নির্মাণ কৌশলে এনেছে আমূল পরিবর্তন। এদেশে পূর্বসূরি-উত্তরসূরিদের হাত ধরেই দেশি মঞ্চাঙ্গনে অনেক নাট্যদল গড়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে নাট্যদলের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু বর্তমানে মঞ্চাঙ্গনে নাটক প্রদর্শনীর জন্য মিলনায়তন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। তাই নিয়মিত নাটক প্রদর্শনী নিয়ে নাট্যদলগুলো বিপাকে রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় ছোট-বড় ৭০টি নাট্য সংগঠন রয়েছে। মঞ্চ সংকটের ফলে নাট্যদলগুলো নিয়মিত নাটক প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারছে না। রাজধানীতে সবমিলে মঞ্চ রয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় নাট্যশালা মূল মঞ্চ, এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল, স্টুডিও থিয়েটার হল, মহিলা সমিতি, গাইড হাউস ও পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের জহির রায়হান মিলনায়তন। এগুলোর মধ্যে আবার অর্ধযুগ ধরে গাইড হাউস বন্ধ রয়েছে। শহরের নাট্যপ্রেমীদের চাহিদা মেটাতে বাকি চারটি মঞ্চ একেবারেই অপ্রতুল বলে নাট্যকর্মীদের অভিমত। জাতীয় নাট্যশালার তিনটি ও মহিলা সমিতি মঞ্চ কাছাকাছি। ফলে ঢাকার অপরাপর এলাকার নাট্য দর্শকদের পক্ষে প্রয়োজনমতো নাটক দেখতে আসা অনেকটা কষ্টসাধ্য। শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চ তিনটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। একাডেমি নাট্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র, ভাড়াও কম। তবে নাট্যদলগুলো বলছে, এ মঞ্চগুলো পাওয়া যায় না। জানা যায়, নাট্যশালার মূল মঞ্চে নাটক মঞ্চায়নের পরিবর্তে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, নাটকের শিডিউল পায় না। একসময় বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মঞ্চই ছিল নাটক করার একমাত্র জায়গা। মিলনায়তনটি খোলার পর হলটির ভাড়া দাঁড়ায় অত্যধিক বেশি। বাহাস-বিতর্ক কারণে শিল্পকলা থেকে বেরিয়ে আসা বটতলা, তীরন্দাজ নাট্য উৎসব করলেও অন্য নাট্যদলের আগ্রহ নেই। সর্বসাকুল্যে একটি নাটক প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নাট্যদলগুলোর খরচ পড়ে যায় অনেক বেশি। গত বছর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হলে সবচেয়ে বেশি নাটক হয়েছে। মঞ্চগুলোর ভাড়া তিন থেকে ছয় হাজার টাকা।
সিটি করপোরেশনের জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনটি পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে। কেন্দ্রের সূত্র বলছে, এক নাট্যোৎসবের কয়েকটি প্রদর্শনী ছাড়া এখানে ফেডারেশনভুক্ত কোনো দল নাটক করেনি। প্রায় অর্ধযুগ ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে নাট্যাঙ্গনের ঐতিহ্যবাহী মিলনায়তন গাইড হাউস। জানা যায়, ‘যৈবতী কন্যার মন’-এর পর গাইড হাউসে এ পর্যন্ত কোনো নাটক প্রদর্শন হয়নি।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট নাট্য-নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘মানসম্পন্ন নাটক করতে গেলে মঞ্চের এসব সংকট দূর করা জরুরি। এতগুলো নাট্যদলের জন্য এই কয়েকটি মিলনায়তন একেবারেই অপ্রতুল। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মঞ্চ নির্মাণ জরুরি।’ অন্যদিকে বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, ‘জাতীয় নাট্যশালা নাট্যকর্মীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল। এ মঞ্চে নাটক ছাড়া অন্য কোনো অনুষ্ঠান করতে দেওয়ার সরকারি নীতিমালা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’ বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহম্মেদ গিয়াস বলেন, ‘আমরা কিন্তু বহু বছর থেকে দাবি করে আসছি, ঢাকা শহরে আরও কিছু মঞ্চনাটক প্রদর্শনের স্থান প্রয়োজন। উত্তরা, মিরপুর, গেণ্ডারিয়ায় হল হলে শিল্পকলার ওপর চাপ অনেকটাই কমবে। আমাদের দাবি এ সরকার আমলেও নিয়েছে। উত্তরায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটি হল হবে আর মিরপুরের গোল চত্বরে একটি স্থান তো আগেই ছিল। মহিলা সমিতিতে আরও বেশি নাটক মঞ্চস্থ করা দরকার। তাহলে কিছুটা হলেও চাপ কমবে।’ নাট্যপ্রিয় মানুষজন মনে করেন, শিল্পকলা একাডেমির বিকল্প হিসেবে সারা ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় মিলনায়তনের ব্যবস্থা থাকলে প্রযোজনাগুলো নিয়মিত মঞ্চায়ন করা যাবে। এতে নাটকের মানও বাড়ত। সেই সঙ্গে নতুন দর্শকও তৈরি হতো।