‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে, এবার বল’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’সহ এমন অনেক কালজয়ী গানের কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। গানের ভুবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন তা প্রায় অনেক বছর হলো। মন দিয়েছেন সংসার ও ধর্মকর্মে। পাকিস্তান আমলে রেডিওতে তার নাম বলা হতো শাহনাজ বেগম। মাত্র ১১ বছর বয়সে রেডিও এবং চলচ্চিত্রের গানে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৪ সালে টিভিতে প্রথম গান করেন। শাহনাজ রহমতুল্লাহর বড় ভাই সুরকার আনোয়ার পারভেজ ছিলেন গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বন্ধু। সে সুবাদে শাহনাজ রহমতুল্লাহর বাসায় যেতেন। ফলে তার অনেক গান লেখা গাজী মাজহারুল আনোয়ারের আর আনোয়ার পারভেজের সুরে। আনোয়ার পারভেজ ছাড়াও আলাউদ্দিন আলী, খান আতা প্রমুখের সুরে গান গেয়েছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। পাকিস্তানে থাকার সুবাদে করাচি টিভিসহ উর্দু ছবিতেও গান করেছেন। গান শিখেছেন গজলসম্রাট মেহেদী হাসানের কাছে। গানের মানুষ গান ছাড়া কি আর থাকতে পারে? শোনা যায় সংসার ধর্মের পাশাপাশি অবসরে এখনো গুন গুন করে গান গায় এই গানের পাখি। এই বছরের ২১ এপ্রিল মাত্র ৬০ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান বরেণ্য সুরকার, সংগীত পরিচালক ও মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখন্দ। আর এই কারণে দীর্ঘদিন পর কোনো মিডিয়ার সামনে আসেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ।
লাকী আখন্দ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর প্রথম লাকীর সুরেই আমি গান করি। খুব মনে পড়ে সেদিন সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, লাকী, হ্যাপী আমার বাসায় গিয়েছিলেন। ঘুড্ডি চলচ্চিত্রের ‘ঘুম ঘুম ঘুম চোখে দেয় চুম’ গানটি গেয়েছিলাম। মনে পড়ে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা এবং জাকীর সুর করা এই গানটি গেয়ে আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছিলাম দ্বিতীয় বারের মতো। লাকী খুব ভালো মনের একজন মানুষ ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় গুণ যেটা ছিল তা হলো একই সঙ্গে তিন-চারটি যন্ত্র বাজাতে পারতেন, আবার গানও গাইতেন। তার অকালে চলে যাওয়া সত্যিই আমাদের জন্য কষ্টের এবং ক্ষতির। আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসীব করেন।’
দীর্ঘদিন পর এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে একান্ত একটি ঘরোয়া আয়োজনে নিজের মনে আনন্দ নিয়েই গান গাইলেন তিনি। প্রয়াত সুরকার সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষের সুরের কয়েকটি গানসহ প্রায় আট নয়টি গান পরিবেশন করেন তিনি। এই সংগীত সন্ধ্যায় তার সঙ্গে ছিলেন একজন রবিন ঘোষের সহধর্মিণী নায়িকা শবনম এবং অন্যজন আমাদের দেশের নাট্যাঙ্গনের অন্যতম অভিনেত্রী তারিন। বলা যায়, শবনমেরই চোখের সামনেই একটু একটু করে শাহনাজ রহমতুল্লাহর গায়িকা হয়ে ওঠা। আবার শাহনাজ রহমতুল্লাহর একমাত্র ছেলে ফয়সালের সঙ্গে বাদল রহমানের ‘কাঁঠাল বুড়ি’ চলচ্চিত্রে একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন তারিন। সেই থেকে তারিনকে অনেক স্নেহের চোখে দেখেন শাহনাজ। গানের ভুবন থেকে সরে থাকা ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ৫০ বছর গান করেছি। সংগীত আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আজ আমি যে অবস্থানে আছি, তা সংগীতের জন্যই। শ্রোতাদের ভালোবাসায় আমি ধন্য। কোনো ধরনের অভিমান কিংবা অভিযোগের কারণে গানের জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখিনি। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। অনেক তো হলো, এবার না-হয় নিজের মতো করে জীবনের বাকিটা সময় কাটাই।’গানের জগতে আর ফেরার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শাহনাজ রহমতুল্লাহ বলেন, ‘সে ধরনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আমি সবকিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
সংগীতে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া চারটি গান স্থান পায়। এর মধ্যে আনোয়ার পারভেজের সুর করা দুটি গান, খান আতাউর রহমান, আবদুল লতিফের সুরে দুটি ভিন্ন গান রয়েছে।