সোমবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভালো সিনেমা হলই দর্শক টানতে পারে

ভালো সিনেমা হলই দর্শক টানতে পারে

সিনেমা দেখার মাধ্যম এখন বদলেছে।ভালো সিনেমা হল হিসেবে জমে উঠেছে সিনেপ্লেক্স কালচার। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বসুন্ধরা শপিং মলের স্টার সিনেপ্লেক্স। এরপর যমুনা ফিউচার পার্কে ব্লকবাস্টার এবং শ্যামলী শপিং মলে শ্যামলী সিনেপ্লেক্স। এ নিয়ে লিখেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

শপিং মলকেন্দ্রিক সিনেপ্লেক্সে ফুড কর্নারসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত পরিবেশ থাকায় দর্শক এতে ছবি দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একই সঙ্গে শপিং করা, খাওয়া-দাওয়া, বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকা এবং উন্নত প্রযুক্তি ও মানসম্মত পরিবেশই হচ্ছে সিনেপ্লেক্সের দর্শক আকর্ষণের মূলমন্ত্র। এক সময় ঢাকায় সিনেমা হলের ঐতিহ্য ও ইতিহাস ছিল সমৃদ্ধ। ১৯২৭ সালে রাজার দেউড়িতে প্রথম নির্মাণ হয় ‘কমলা টকিজ’ পরে যা ‘প্যারাডাইস সিনেমা’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৩২ সালে ইসলামপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘লায়ন থিয়েটার’। পরে এর নাম হয় ‘লায়ন সিনেমা’। শুধু উৎসবে নয়, সারা বছর দর্শক সপরিবারে আনন্দঘন পরিবেশে সিনেমা হলে যেতেন। দর্শক চাহিদায় নব্বই দশক পর্যন্ত ৪৪টি সিনেমা হল নির্মাণ হয় ঢাকায়। সারা দেশে এ সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে  তেরো শ। সিনেমা হল বাড়লেও বেশির ভাগ সময়ই টিকিট পাওয়া যেত না হলগুলোতে। হলের সামনে ঝুলত ‘হাউস ফুল’  লেখা সাইনবোর্ড। আজ সেই সোনালি সময় আর নেই। বর্তমানে সারা দেশে সিনেমা হল আছে ২৮০টির মতো। দুই ঈদে মৌসুমি সিনেমা হল হিসেবে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০-এ। আর ঢাকায় আছে ২৮টি সিনেমা হল। এগুলো হলো— আজাদ, চিত্রামহল, মানসী, অভিসার, নেপচুন, গীত, সংগীত, আগমন, জোনাকী, রাজমণি, রাজিয়া, পদ্মা, সুরমা, গ্যারিসন, শাহীন, সনি, পূরবী, এশিয়া, পর্বত, মুক্তি, শ্যামলী, বিজিবি অডিটোরিয়াম, বলাকা, পূর্ণিমা, আনন্দ, ছন্দ, পুনম ও মধুমিতা।

ঢাকার সিনেমা হলগুলোর ব্যবসায়িক চিত্র এখন খুব একটা সুখকর নয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি সূত্রে জানা যায়, চিত্রামহল, সনি, এশিয়া, মধুমিতা, অভিসার ও বলাকায় কিছু দর্শক পাওয়া যায়। কারণ এখানে ঠিকভাবে ছবি প্লেস করা হয় এবং কোনো কোনোটির পরিবেশও অনেকটা ভালো। অন্যদিকে সঙ্গীতা, ছন্দ, সুরমা, নেপচুনের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দর্শকের অভাবে এগুলো এখন বন্ধের পথে। এ প্রসঙ্গে  চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, সিনেমা হল বন্ধ রোধ, নতুন হল নির্মাণ তখনই সম্ভব হবে যখন চাহিদামতো ছবি পাওয়া যাবে। অনেক দিন ধরে স্থানীয়ভাবে মানসম্মত ছবি নির্মাণ হচ্ছে না। তাই দর্শক এখন সিনেমা হলবিমুখ। সিনেমা হল বা এ ব্যবসা বাঁচাতে অবাধে বিদেশি ছবি প্রদর্শন এবং দেশীয় ভালো ছবি নির্মাণ করতে হবে। না হলে সরকারি অনুদান বা যেভাবেই  হোক সিনেমা হল নির্মাণ করে লাভ নেই। লোকসান গুনতে গুনতে এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। আজাদ, মানসী, আনন্দ, অভিসার ও আগমন সিনেমা হল বন্ধের তালিকায় আছে বলে  শোনা যাচ্ছে।

বন্ধ হওয়া লায়ন সিনেমার কর্ণধার মির্জা আবদুল খালেক বলেন, ছবির অভাবে আমার সিনেমা হলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। মাঝে-মধ্যে চলার মতো দু-একটি ছবি পেলেও  দেখার মতো ছবির অভাবে দর্শক আর সিনেমা হলে আসছেন না। তাই যৌথ প্রযোজনা, বিদেশি ছবি আমদানি এবং মানসম্মত  দেশি ছবি নির্মাণ ছাড়া সিনেমা হল বাঁচানোর আর কোনো পথ  নেই। নাটক মার্কা ছবি নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। একটি সিনেমা হল চালাতে মাসে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা ব্যয় হয়। তাই সরকারি অনুদান দিয়ে সিনেমা হল সংস্কার বা নির্মাণ করে  কোনো লাভ নেই। আর যে পদ্ধতিতে সরকার অনুদান দিতে যাচ্ছে তা ভুল। এতে অনুদানের এককালীন এই টাকার অপচয়ই শুধু হবে, আর কিছু নয়। সরকার অনুদানের জন্য যে কমিটি  তৈরি করেছে তা যথার্থ হয়নি। বিষয়টি এমন ছিল সরকার যাদের চোখের সামনে দেখেছে তাদের নিয়েই আলাপে বসে  গেছে। অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের ডাকার আর প্রয়োজন মনে করেনি। এভাবে সিনেমা হল বাঁচানো যাবে না।

প্রদর্শক সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, সিনেপ্লেক্স নির্মাণ ব্যয়বহুল। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে গেলে ছবির অভাবে লোকসান গুনতে হবে। তখন ব্যাংক থেকে নেওয়া লোনের টাকা সুদসহ ফেরত দিতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হবে। তাই আগে ছবির চাহিদা পূরণে ভালো ছবি নির্মাণের পাশাপাশি বিদেশি ছবির আমদানি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। মধুমিতা সিনেমা হলের অন্যতম কর্ণধার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদ বলেন, চাহিদা অনুযায়ী এবং মানসম্মত ছবি না পাওয়া গেলে সিনেমা হলের যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন কোনোভাবেই এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বছরে দুই ঈদ ছাড়া এখন অন্য কোনো সময় দর্শক সিনেমা হলে আসেন না বললেই চলে। কারণ ঈদেই শুধু কিছুটা গুণগতমানের ছবি পাওয়া যায়। এ অবস্থায় কীভাবে হল টিকিয়ে রাখব।

স্টার সিনেপ্লেক্সের সিনিয়র বিপণন কর্মকর্তা মেসবাহউদ্দীন বলেন, মানসম্মত ছবি এবং উন্নত পরিবেশের কারণে সিনেপ্লেক্স কালচার দ্রুত দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। এটি হচ্ছে সিনেমা দেখার আধুনিক ব্যবস্থা। বিশ্বে অনেক আগেই এ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আমার মতে, দেশে যদি বেশি পরিমাণে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ হয় তাহলে দর্শক আবার সিনেমা হলে এসে ছবি দেখতে আগ্রহী হবে। তবে ভালো ছবি অবশ্যই নির্মাণ হতে হবে। দেশি ছবি  পেলেই আমরা তা প্রদর্শন করি। দেশীয় ভালো ছবি নিয়মিত পাওয়া যায় না বলে বিদেশি ছবি বেশি প্রদর্শন করতে হয়।’

 

সর্বশেষ খবর