শুক্রবার, ৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

পথনাটক প্রদর্শনী : সদিচ্ছা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব

পথনাটক প্রদর্শনী : সদিচ্ছা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব

নাট্যাঙ্গনের অন্যতম অর্জন আমাদের মঞ্চ ও পথনাটক। তবে স্বাধীনতার আগে যে পথনাটক মঞ্চস্থ হতো তার বেশির ভাগই ছিল সামাজিক ও সচেতনতামূলক।  সে সময় পথনাটক মুক্তির প্রতিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু স্বাধীনতার আগে ও পরে পথনাটক মঞ্চায়নে কিছুটা গতি পেলেও বর্তমানে পৃষ্ঠপোষকতা এবং সদিচ্ছার অভাবে পথনাটক প্রদর্শনী অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। পথনাটক প্রদর্শনী এবং এর আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন— পান্থ আফজাল

 

প্রসেনিয়াম আর্চের বাইরে পথে-প্রান্তরে বা উন্মুক্ত স্থানে অভিনীত নাটক হচ্ছে পথনাটক। জীবনেরই প্রতিধ্বনি উঠে আসে পথনাটকে। পথনাটকে উচ্চারিত হয় শেকল ভাঙার গান। শুধু রাষ্ট্রই নয়, সমাজের সচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ত পালাবদলের ইতিহাস প্রবহমান হয়েছে বাংলাদেশের পথনাটকে। আমাদের পথনাটকের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক পুরনো হলেও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এর চর্চা, গড়ে ওঠেনি পথনাটকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নাটক হতো বেশি। মঞ্চে তখন নাটক করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবে পথনাটক হতো। এসব নাটক সেই সময় মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নাটকের পুরো কাঠামোই পাল্টে যায়। বিজয় অর্জনের পর থেকে মুক্তির স্বাদ নিতে নিতে আমাদের নাটকের নির্মাণ ও অভিনয় প্রয়োগে প্রতিনিয়ত নতুনত্বের আবির্ভাব দেখা দেয়। মঞ্চনাটকের পাশাপাশি পথনাটকেও মুক্তিযুদ্ধকে তুলে এনেছিলেন নাট্যকর্মীরা। তবে নাটক মঞ্চস্থ করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বড়ই অভাব।

বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা বর্তমান পথনাটকের কার্যক্রম নিয়ে বলেন, ‘পথনাটক প্রদর্শনীর একটি সিজন থাকে। বর্ষাকালে তো আর করা যায় না। পথনাটকগুলো শীত মৌসুমেই নিয়মিত হয়। গত দুই মাসে পথনাটক নিয়ে উৎসব হয়েছে। আবার মার্চের ১ থেকে ৮ তারিখ বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের উদ্যোগে শুরু হয় পথনাটক উৎসব। অনেক হচ্ছে, তবে নীরবে-নিভৃতে হওয়ার কারণে পথনাটকের কার্যক্রম তেমন চোখে পড়ে না। ঢাকার বাইরে অর্থাৎ উত্তরায়ও কিন্তু ২৩, ২৪ তারিখে পথনাটক প্রদর্শনী হবে। তবে এখন কম দৃশ্যমান রাজনৈতিক অবস্থার কারণে।’

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘পথনাটক হচ্ছে। তবে সেই ৮০ বা ৯০ দশকে যে মুখরতা ছিল তা এখন স্তিমিত হয়ে গেছে। কোনোরকম ইস্যু ছাড়া পথনাটক হচ্ছে। নানা রকম অজ্ঞাত কারণে কেউ মুখ খুলছে না। আমি কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে পথনাটক লিখেছি, করেছি। এখন কেউই কোনো ইস্যু নিয়ে লিখছে না, তাই পথনাটকের কার্যক্রম চোখে পড়ছে না তেমন করে। ’

নাট্যজন ড. ইনামুল হক পথনাটকের আন্দোলনকে তুলে ধরে বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে বিভিন্ন আন্দোলনমুখী পথনাটকেরও প্রদর্শনী হতো। ওই সময় রবীন্দ্রনাথের নাটক-গান প্রচারের ওপর তৎকালীন মোনায়েম সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই বিধি-আরোপের মুখেও আমরা বিভিন্ন মঞ্চ ও পথনাটক মঞ্চস্থ করতে পিছু হটিনি। এখনো হচ্ছে, তবে চোখে পড়ছে না তেমন করে।’

মঞ্চসারথি আতাউর রহমান পথনাটকের বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর অনেক হয়েছে। এখন কিন্তু কম হচ্ছে। আর আমি পথনাটকের সঙ্গে তেমন করে যুক্ত নই। আগে ৫-৬টি দল কাজ করত। এখন তো মাসে ১টি নাটকও করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই জ্যাম আর বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে মঞ্চ ও পথনাটক তেমন করে করা সম্ভব হচ্ছে না। আর প্রত্যেক জিনিস তো আর সমান্তরালে যায় না। পথনাটকে সুদৃষ্টি ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। কেউ এই বিষয় নিয়ে ভাবছে না। আরও বেশি বেশি পথনাটক প্রদর্শনী হওয়া উচিত।’

নাট্যজন আবুল হায়াত বলেন, ‘আমি তো আসলে এখন তেমন করে মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত নই। তবে পথনাটক যে হচ্ছে না তা বলা যাবে না। হচ্ছে অনেক, কিন্তু আকাশ সংস্কৃতি ও মিডিয়ায় প্রচারের অভাবে এর কার্যক্রম ঢাকা পড়ে গেছে। স্বাধীনতাপূর্ব ও পরে পথনাটক অনেক হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এক সময় মঞ্চনাটকের পাশাপাশি পথনাটকেও মুক্তিযুদ্ধকে তুলে এনেছিলেন নাট্যকর্মীরা।’

১৯৭৭ সালে ঢাকা থিয়েটার সেলিম আল-দীন রচিত ‘চর কাঁকড়ার’ ডকুমেন্টারি নামে প্রথম পথনাটক ঢাকায় প্রদর্শন করে। পরে পদাতিক নাট্য সংসদ এস এম সোলায়মান রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাঁচাল’ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ করে। আশির দশকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন পথনাটক উৎসব পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

১৯৮৭ সালে ঢাকার নাট্যদল মহাকাল, সুবচন, গণছায়া, মহানগরী ৭৭ একত্রিত হয়ে নিয়মিত পথনাটক প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেয়। নব্বইয়ে দেশব্যাপী স্বৈরাচারী সরকার পতনের সংগ্রামে নাট্য আন্দোলনটি হয়েছিল একটু ভিন্ন। পথনাটক এই সময়ে নাট্যকর্মীদের যতটুকু সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে উঠেছিল, মঞ্চনাটকে দু-একটি উল্লেখযোগ্য নাটক ছাড়া সে রকম কোনো বিষয় তখন প্রতিবাদে গর্জে ওঠেনি।

১৯৭১ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত এবং আজও তাই গণমানুষের সংগ্রামী হাতিয়ার এই পথনাটক। ১৯৯২ সালে পথনাটক চর্চার গতিকে আরও বেগবান করার অভিপ্রায়ে মহাকাল, ঢাকা নাট্যম ও দেশ নাটক সমন্বিতভাবে পথনাটকের প্রদর্শনী শুরু করে। ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পথনাটক পরিষদ’। পরে প্রতি বছর শীতকালে অনুষ্ঠিত হতে থাকে পথনাটক প্রদর্শনী। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা ও সদিচ্ছার অভাবে পরবর্তীতে খুব বেশি পথনাটক প্রদর্শনী হয়নি।

আজ বলছি পথ হারিয়েছে বাংলাদেশের পথনাটক। পথনাটকে আয়ের সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কোটায় থাকায় এই নাটক পরিচালনায় ও প্রদর্শনীতে এখন তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না মঞ্চনাটক সংগঠনগুলো। তাই ধীরে ধীরে সভ্যতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলাদেশের পথনাটকের অতীত ইতিহাস ও বর্তমান কার্যক্রম। বাংলাদেশের পথনাটকের অতীত ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে সবার প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে মঞ্চনাটকের কর্তাব্যক্তিদের। থিয়েটারের কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা ও সম্মিলিত প্রয়াসই পারে পথনাটকের অতীত ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে।

সর্বশেষ খবর