বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ : অঞ্জন দত্ত কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা ও পরিচালক

অনেক মহিলার সঙ্গে প্রেম করেছি

অনেক মহিলার সঙ্গে প্রেম করেছি

বাংলা গানের জীবন্ত কিংবদন্তি অঞ্জন দত্ত। গান লেখেন, সুর করেন আবার নিজেই কণ্ঠে তোলেন। দোর্দণ্ড প্রতাপে অভিনয় করছেন, চলচ্চিত্র পরিচালনা করছেন। তার জীবনের নানা অজানা দিক নিয়ে বাংলাদেশি লেখক সাজ্জাদ হুসাইন লিখেছেন ‘অঞ্জনযাত্রা’। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই তিনি ঢাকায় এসেছেন। দীর্ঘ জীবনে তিনি সম্মুখীন হয়েছেন বহু অভিজ্ঞতার। তার সেই অভিজ্ঞতা ও সমসাময়িক নানা বিষয় তুলে ধরেছেন— পান্থ আফজাল

 

হঠাৎ নিজের জীবনী নিয়ে বই বের করার উদ্যাগী হলেন কেন? 

আমি মনে করি, কাজের বাইরেও একটি মানুষ থাকে। সে যা করে, এর বাইরে তার একটি জগৎ থাকে। এই বইয়ে মূলত সেই আমিকে বের করে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, লেখক তার সততা দেখিয়ে আমাকে মুগ্ধ করেছেন বলে আমিও সব সত্য কথা বলে দিয়েছি। এই বই পড়ার পর হয়তো আমার সম্পর্কে মানুষের ভাবনায় পরিবর্তন আসবে। এর আগে অনেকে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কিন্তু এই বইয়ের জন্য আমি যে সাক্ষাৎকার দিয়েছি, তা আর কোথাও দিইনি। কোনো সাক্ষাৎকার নিয়ে এত উচ্চাশা হয়নি, যা এই বইয়ে দিয়েছি। বইয়ের লেখক সাজ্জাদ হুসাইন প্রশ্ন করেছে, তা কেউ করেনি।

 

‘অঞ্জনযাত্রা’-এর যাত্রার পেছনের কাহিনী একটু খোলাসা করে বলবেন কি?   

এই বইকে আমার জীবনীও বলতে পারেন। অনেকে আমার ইন্টারভিউ করতে চেয়েছিল বিভিন্নভাবে কিন্তু আমি রাজি হইনি। সাজ্জাদ যখন আমাকে প্রথম ফোন করেছিল তখন মনে হয়নি সে আমাকে ইম্প্রেস করার জন্য কিছু করছে। তবে দুই-একবার কথা বলতে বলতে আমি সাজ্জাদকে বিশ্বাস করে ফেলি। লাকি আখন্দের কথার মতোই আমি বিমুগ্ধ হয়ে যাই। সাজ্জাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো যে, ও অন্যভাবে করবে, যে কথাগুলো কেউ জানে না। হয়তো ওর জানতে চাওয়া বা আমাকে বুঝতে চাওয়ার ইচ্ছাটা অন্যরকম। আমার ধারণা, ও কোনো চটক বা রগরগে কেচ্ছা খুঁজছে না এবং বড় মাপের দার্শনিক কোনো সত্যও খুঁজছে না। ও খুঁজছে একটা মোটামুটি সার্থক শিল্পীর যন্ত্রণা এবং সংগ্রামের অন্তরঙ্গ গল্প। সত্যি কথা না থাকলে আত্মকথা হয় না। ও খুঁজছে সেই অঞ্জনকে, যাকে কেউ বুঝতে পারেনি। আমাকে যদি আমার কথা বলতে হয় আমার সব কথা বলতে হবে। যেমন- আপনি কবে প্রেমে পড়েছিলেন, কবে কয়টি খারাপ কাজ করেছিলেন, কারও টাকা মেরে দিয়েছিলেন কিনা! আমি সত্যি করে বলছি, বিন্দুমাত্র মিথ্যা কথা বলব না। এই সত্যি কথাগুলোকে যদি কেউ একটি রেসপেক্টেড জায়গা থেকে লিখতে পারে তাহলে তার একটা মানে হবে; তা না হলে সেটা রগরগে একটা কেচ্ছা-টেচ্ছা কিছু হবে— এতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। বইটা পড়ার পর না আমার সম্পর্কে আপনার সব বিষয় ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

 

আচ্ছা অঞ্জন দত্ত কি সেই ১৫ তেই আটকে আছে?

১৫ তে আটকে নেই আমি! (একটু দৃঢ়স্বরে)

 

রমা, রঞ্জনা, মালা, বেলাবোস, জয়িতা, মেরি এ্যানের সঙ্গে আপনার বাস্তব জীবনের কোনো সম্পর্ক আছে কি?

বাস্তব জীবনে আমি প্রচুর মহিলার সঙ্গে প্রেম করেছি; কিন্তু বাস্তব জীবনে রমা, রঞ্জনা, মালা, বেলাবোস, জয়িতা, মেরি এ্যান— এদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই! এগুলো গল্পের চরিত্র। তবে এই মানুষগুলো আমার অনেক চেনা মনে হয়। আর শুধু মেয়েদের নাম কেন? অনেক ছেলের নামেও তো আমি গান করেছি! আলীবাবা, হুরিপদ আমার খুব চেনা। জারমিন, স্যামসন আমার পরিচিত নয়; তবে আমি কিন্তু তাদের দেখেছি। জীবনের উপলব্ধি তারা।  

 

আপনার গানের চরিত্র মিস্টার হল নামে আদৌ কি কেউ ছিল?

আসলে মি. হল নামে কেউ ছিল না। একজন মহিলা ছিল। মহিলার নামটা এই বইয়ে আছে। তাকে নিয়ে গানটা একটু বানানো গান। মহিলা আমাদের অনেক সিনিয়র, মিউজিক টিচার টিমে ছিলেন। তবে প্রথম আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম।

 

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লাকী আখন্দের সঙ্গে ১৯৯৯ সালে ‘হ্যালো বাংলাদেশ’ অ্যালবাম বের করেছিলেন। লাকী আখন্দকে নিয়ে সে সব স্মৃতির কিছু জানতে চাই...

১৯৯৮-এর এপ্রিল মাস নাগাদ আমি প্রথম বাংলাদেশে যাই, গান গাইতে। ঢাকার ন্যাশনাল মিউজিয়াম অডিটোরিয়ামে আমাদের শো। প্রথমবার ঢাকা, হলভর্তি শ্রোতা, দারুণ লাগছে। হঠাৎ শো’র মাঝামাঝি আমাদের জলসার উদ্যোক্তা নিমা রহমান আমায় জানান, হলে একজন শিল্পী উপস্থিত, যিনি এক সময় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাকে আমি চিনি না, তার গানও কখনো শুনিনি। কিন্তু একেবারেই নিছক আসর জমানোর উদ্দেশে হঠাৎ তাকে মঞ্চে আসতে আহ্বান করলাম। তিনিও দিব্যি উঠে এলেন এবং আমার সঙ্গে গান-বাজনা করতে শুরু করে দিলেন। যদিও তাকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আমার কোন গানটা গাইবেন বলুন তো?’। তিনি বলেছিলেন, আমার গান তিনি আদৌ শুনেননি। দিব্যি গান গাওয়া হলো, আসর জমে গেল। ভাই হ্যাপীর মৃত্যুশোকে বহু বছর যে শিল্পী গান গাওয়া বন্ধ করে চুপ মেরে বসেছিলেন হঠাৎ আবার গান গেয়ে উঠলেন। তার সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তারপর তার সঙ্গে তেমনভাবে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। আমি যখন জানলাম যে, ওর শরীর খারাপ তখন তার মেয়ের মোবাইলে কল দিতে তার সঙ্গে কথা হতো। কারণ লাকীর মোবাইল বন্ধ ছিল। তবে জীবনে খুব কমই আমি অন্য কোনো শিল্পীর সঙ্গে গান গাইতে গিয়ে এতটা এনজয় করেছি। গান করতে করতে বন্ধুত্ব আর কি! এরপর তার সঙ্গে আরও একটা অ্যালবাম করেছিলাম।

 

জীবনে গায়ক না হয়ে একজন অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন...

আমি গায়ক হিসেবে পরিচিতি পেলেও অভিনেতাই কিন্তু হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা কি পেরেছি? গান গেয়ে আমার নামডাক হয়েছে। গান গেয়ে মানুষের সবচেয়ে বেশি কাছে এসেছি, ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু সত্যি কথা হলো, জীবনে যা হতে চেয়েছি, তা হতে পারিনি। সত্যি এ জীবনে আমি ভালো অভিনেতা হতে চেয়েছি। জীবনে ৪০-৪২ বছর পর অনেক কিছুই কিন্তু ছেড়ে দিয়েছিলাম। এরপরও কিছু একটা করছি আর কি! ইচ্ছা ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতা হব। কিন্তু তিনি এক অনন্য উচ্চতায় চলে গেছেন। আমি তাকে ছাড়িয়ে যেতে কখনোই পারিনি, পারব না। এই বয়সে আর সম্ভব নয়! গানই আমার পরিচয়। অভিনেতা হিসেবে সেভাবে পরিচিতি পাইনি। বড় মাপের পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি, কিন্তু বড় অভিনেতা হতে পারিনি। আমি এখন আর নতুন করে অভিনেতা হওয়ার চেষ্টা করি না। আমি মনে করি, একটা সময় যেভাবে অভিনেতা হওয়ার জন্য কাজ করেছি, তা এখন আর সম্ভব নয়। যদি বয়স কম হতো, তাহলে অভিনেতাই হতে চাইতাম। গান না গাইলে হয়তো এই অঞ্জন দত্ত হারিয়েই যেত।

 

সবকিছুর অনুপ্রেরণা কে?

কে আবার, আমি নিজে! (একটু মুচকি হেসে)

 

বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার মূল্যায়ন কীভাবে করবেন?

আমি এই যে শার্টটি পরেছি তা কিন্তু ১০০% বাংলাদেশি। আর আমার ভক্তদের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশের। প্যারিসে গিয়েছি, আমেরিকায় গিয়েছি বা যেখানেই গিয়েছি, বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি।

সর্বশেষ খবর