শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

চঞ্চল মন আমার শুনে না কথা...

আলী আফতাব

চঞ্চল মন আমার শুনে না কথা...

জাত অভিনেতা বলতে যেটা বোঝায়, তিনি সেটাই। নিজেকে নায়ক বা তারকা নয়, একজন অভিনয়শিল্পী ভাবতেই পছন্দ তার। নাটকে নিয়মিত, কিন্তু বড় পর্দায় তার দেখা মেলে দীর্ঘ বিরতির পর। সিনেমায় কাজ করেন খুব বেছে বেছে, কারণ নাটকে অভিনয় করাটা তার কাছে পেশা আর সিনেমাটা নেশা, সম্মানের জায়গা। এটুকু তিনি নিশ্চিত করতে চান, লোকে যেন তার সিনেমা দেখতে গিয়ে বিরক্ত না হন। আর সে কারণেই এত বাছাবাছি। পরিসংখ্যান আর ইতিহাস বলছে, এই বাছাইয়ের ফল কিন্তু শুভ। যে ক’বারই তাকে ছোটপর্দা ছেড়ে বড়পর্দায় কাজ করতে দেখা গেছে, নিজের অভিনয় প্রতিভার সবটুকু সেখানে ঢেলে দিতে পেরেছেন তিনি। ক্যারিয়ারে মোট সিনেমার সংখ্যা মাত্র পাঁচটি, এর মধ্যে সেরা অভিনেতা হিসেবে বাগিয়ে নিয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। তিনি ‘মনপুরা’র সোনাই, ‘মনের মানুষে’র কালুয়া, ‘টেলিভিশনে’র সোলায়মান, ‘আয়নাবাজি’র আয়না ও ‘দেবী’র মিসির আলি- তিনি আমাদের চঞ্চল চৌধুরী। ‘দেবী’ ছবির পর তিনি অভিনয় করতে যাচ্ছেন গোলাম সারোয়ার দোদুলের নতুন একটি ছবিতে। সাংস্কৃতিক একটি পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন এই গুণী শিল্পী। অল্প বয়সে গানবাজনা শিখেছিলেন, কিন্তু পরে আর সেসবে জড়াতে ইচ্ছে হয়নি। ঢাকায় এসে প্রথম মঞ্চনাটক দেখার অভিজ্ঞতা হলো চঞ্চল চৌধুরী নামের সেই ছেলেটার, কৈশোর থেকে তখন যৌবনে পদার্পণের প্রহর গুনছিল যে। অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় আক্রান্ত হলেন চঞ্চল চৌধুরী। সেই মুগ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে চলা সম্ভব হলো না তার পক্ষে, ১৯৯৬ সালে যোগ দিলেন মামুনুর রশীদের ‘আরণ্যক নাট্যদলে’। দীর্ঘদিন তিনি মঞ্চের ব্যাকস্টেজে কাজ করেছেন। আরণ্যকের হয়ে তিনি প্রথম অভিনয় করেন ‘কালো দৈত্য’ নাটকে। তারপর সংক্রান্তি, রাঢ়াঙ, শত্রুগণ- তালিকাটা কেবল দীর্ঘ হয়েছে।

২০০০ সালে প্রথমবারের মতো টিভি নাটকে অভিনয়ের সুযোগ এলো। নাটকের নাম গ্রাস, পরিচালক ছিলেন ফরিদুর রহমান। সেই থেকে শুরু বোকাবাক্সে চঞ্চল চৌধুরী যুগের। সিনেমা মানে তার কাছে কমার্শিয়াল বা অফট্র্যাক না, সিনেমার অর্থ চঞ্চলের কাছে দুটো- ভালো সিনেমা আর খারাপ সিনেমা। চঞ্চল চৌধুরীর সিনেমায় যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘রূপকথার গল্প’ দিয়ে, তৌকীর আহমেদের হাত ধরে। বেকার যুবকের চরিত্রে সিনেমা জগতে নবাগত চঞ্চল চৌধুরীর সে কি দারুণ অভিনয়! কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটার জন্য তার মায়া ছুঁয়ে গিয়েছিল দর্শককেও। তারপর এলো মনপুরা, বাংলা চলিচ্চিত্রের ইতিহাসে সৃষ্টি করলেন গিয়াসউদ্দীন সেলিম। সোনাই আর পরীর ভালোবাসা, তাদের বিচ্ছেদের কষ্ট মানুষ আজও মনে রেখেছে। তারপর একে একে এলো ‘মনের মানুষ’ আর ‘টেলিভিশন’। ২০১৬ সালে মুক্তি পেল ‘আয়নাবাজি’। একবিংশ শতাব্দীতে যতবার বাংলা সিনেমার প্রসঙ্গ আসবে, ততবারই আয়নাবাজির নাম উঠবেই। চঞ্চলময় একটা সিনেমা, অমিতাভ রেজার ডিরেকশনে দেড় ঘণ্টার মধ্যে দশ-বারোটা চরিত্রে তাকে দেখে ফেলল দর্শক! এই তিনি আয়না, পরক্ষণেই আবার জেলখাটা আসামি, কয়েক দৃশ্য বাদেই ধর্ষক হয়ে জেলে যাচ্ছেন, মাঝে আবার তাকে প্রেমিক হিসেবে বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকায় ভাসতে দেখা যাচ্ছে। আবার তিনি হয়ে যাচ্ছেন রাজনীতিবিদ নিজাম সাঈদ চৌধুরী চরিত্রের এমন দুর্দান্ত ট্রান্সফরমেশন বাংলা চলচ্চিত্র এর আগে কবে দেখেছে? সিনেমা বাছাইয়ের ব্যাপারে নিজের খুঁতখুঁতে মনোভাবের কথা অকপটেই স্বীকার করেন চঞ্চল চৌধুরী। আর এ কারণেই তিনি জানেন না একটা সিনেমা শেষ হওয়ার কয় বছর বা মাস বাদে আরেকটা সিনেমার কাজ ধরবেন তিনি। টেলিভিশনের পরে চার বছর যেমন সিনেমায় দেখা যায়নি তাকে। আবার গল্প আর চরিত্র পছন্দ হয়েছে বলে আয়নাবাজির কয়েক মাস পরই কাজ করেছেন ‘দেবী’ সিনেমায়। তবে ‘দেবী’তে কাজ করার ব্যাপারে দারুণ ভয় কাজ করছিল তার মধ্যে। কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে ‘মিসির আলি’ চরিত্রে অভিনয় করাটা তো চাট্টিখানি কথা নয়।

এ প্রসঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী বলেন, মিসির আলি চরিত্রে অভিনয় করাটা আমার জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ আয়নাবাজির পর দর্শকদের একটা প্রত্যাশার চাপ রয়েছে। আর মিসির আলি বহুল পঠিত একটা উপন্যাসের চরিত্র। যারা হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি পড়েছেন কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয় জানেন, তাদের মধ্যে একটা মিসির আলি বাস করেন। তারা আমাকে সেভাবেই দেখতে চাইবেন। সেটি মাথায় রেখে একটি চরিত্রায়ন করা খুব কঠিন। আমি প্রতিটি সিনেমার আগে, প্রতিটি চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করেছি। একটি মিসির আলি চরিত্রের জন্য আমরা অনেকভাবে নিজেকে সাজানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি বলতে পারি ‘দেবী’ সিনেমায় দর্শক আমাকে নতুন একটি মিসির আলি চরিত্রে দেখতে পাবেন।

এ ছবিতে যেভাবে কাজ করেছি এমন গেটআপে কেউ কখনো আমাকে দেখেনি। এসব আমি উপভোগ করি। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে পারলেই শিল্পী দারুণ কিছু শিল্প তুলে আনতে পারেন অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। সরকারি অনুদানে তৈরি হয়েছে ‘দেবী’ চলচ্চিত্রটি। এ ছবির প্রযোজক চিত্রনায়িকা জয়া আহসান। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘সি-তে সিনেমা’। পরিচালক অনম বিশ্বাস। ‘মিসির আলি’ চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী ছাড়াও ‘দেবী’ ছবিতে ‘রানু’ চরিত্রে অভিনয় করছেন জয়া আহসান। রানুর স্বামী আনিসের চরিত্রে অনিমেষ আইচ, নীলু চরিত্রে শবনম ফারিয়া আর আহমেদ সাবেরের চরিত্রে দেখা মিলবে ইরেশ যাকেরের। হয়তো আমাদের একজন ডেনিয়েল ডে লুইস নেই, নানা পাটেকার, মনোজ বাজপাই বা ইরফান খান নেই। অথচ আমাদের একজন চঞ্চল চৌধুরী তো আছেন! যার চঞ্চল মনে বাস করে অভিনয়ের নানা চরিত্র।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর