সংগীতের মাঝেই জীবনটাকে বেঁধেছিলেন তিনি। সুরের মায়াজালে জায়গা করে নিয়েছিলেন শ্রোতাদের অন্তর। আজকের এই দিনে সুরের বাঁধন ছিঁড়ে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। সত্যিই ফেরানো গেল না তাকে। রেখে গেলেন আপন সৃষ্টি আর সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভক্ত, অনুরাগী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহযোদ্ধাদের উজাড় করা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। লাকী আখন্দ আধুনিক বাংলা গানের বরপুত্র। সবার প্রিয় একজন মানুষ। তার দুর্দান্ত কণ্ঠশৈলী, অনুপম সুর সৃষ্টি আর জাদুকরী সংগীত পরিচালনার মুনশিয়ানায় দেশের সংগীতকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাংলা গানের এক নতুন ধারা সূচনা করেছিলেন তিনি। শৈশবেই তার সংগীত শিল্পী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ ঘটে। লাকী আখন্দের জন্ম ১৯৫৬ সালে পুরান ঢাকায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে এইচএমভি পাকিস্তানে সুরকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৬ বছর বয়সে সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন এইচএমভি ভারত এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও। স্বাধীনতার পর পর নতুন উদ্যমে বাংলা গান নিয়ে কাজ শুরু করেন লাকী আখন্দ। যেমন নিজে গেয়েছেন, তেমনি অন্যদের দিয়ে গাইয়েছেনও। তার সৃষ্টিতেই ভাই হ্যাপী আখন্দ গেয়েছেন বিখ্যাত গান ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে, ফেরদৌস ওয়াহিদের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছে ‘মামুনিয়া’, আগে যদি জানতাম, কুমার বিশ্বজিৎ গেয়েছেন যেখানে সীমান্ত তোমার, আইয়ুব বাচ্চু গেয়েছেন কি করে বললে তুমি, বিতৃষ্ণা জীবনের আমার, জেমসের কণ্ঠে লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া, ভালোবেসে চলে যেও না, সামিনা চৌধুরীর কণ্ঠে কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে, আমায় ডেকো না প্রভৃতি। লাকী আখন্দ ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ঘুড্ডি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন। এই চলচ্চিত্রে তার ভাই হ্যাপী আখন্দের গাওয়া ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে হ্যাপী আখন্দের একটি অ্যালবামেও গানটি ব্যবহৃত হয় এবং অ্যালবামটির সংগীতায়োজন করেন লাকী। ১৯৮৪ সালে তিনি তার প্রথম একক অ্যালবাম লাকী আখন্দ প্রকাশ করেন। আখন্দের সংগীতচর্চা বন্ধ হয়ে যায় তার ছোটভাই হ্যাপী আখন্দ ১৯৮৭ সালে মারা যাওয়ার পর। তিনি প্রায় এক যুগ পরে ১৯৯৮ সালে ‘পরিচয় কবে হবে’ ও ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ অ্যালবামে সংগীতায়োজনের মাধ্যমে গানের ভুবনে ফিরে আসেন। একই বছর তিনি ‘আনন্দ চোখ’ নামে একটি দ্বৈত অ্যালবাম প্রকাশ করেন। পরের বছর লাকী আখন্দ সামিনা চৌধুরীর একক অ্যালবাম ‘আমায় ডেকো না’র সংগীতায়োজন করেন। এ ছাড়া তিনি ব্যান্ডদল আর্কের ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা’ গানের সুর করেন।
২০০০ সালের পর তিনি আরেকটি মিশ্র অ্যালবাম তোমার অরণ্যের সুর ও সংগীতায়োজন করেন। এতে লাকী আখন্দের কণ্ঠে গাওয়া তিনটি গানসহ বাপ্পা মজুমদার, ফাহমিদা নবী ও নিপুর কণ্ঠে ১০টি গান ছিল।
১৯৬৯ সালে লাকি আখন্দ পাকিস্তানি আর্ট কাউন্সিল থেকে বাংলা আধুনিক গান বিভাগে পদক লাভ করেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীসহ সংগীতজগৎ গভীর শোক প্রকাশ করেন।লাকী আখন্দের স্বপ্ন ছিল শিল্পীদের আর যেন কাজের জন্য কারও দ্বারস্থ হতে না হয়। কিন্তু তিনি নিজেও জানতেন কাজটা অত সহজ নয়। তারপরও তিনি তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু স্বপ্নটা আর পূরণ করে যেতে পারলেন না। তার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরতরে চলে গেলেন অদেখার ভুবনে।