রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

সিনেমা হলে দর্শক ফিরবে যেভাবে

সিনেমা হলে দর্শক ফিরবে যেভাবে

নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে সিনেমা হল দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শকদের মতে, মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ছবি নির্মাণ হচ্ছে না। দর্শকের অভাবে সিনেমা হলের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। সমিতির তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা তিনশতেরও কম। অথচ নব্বই দশকের শেষভাগ পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৫০। কীভাবে আবার সিনেমা হলে দর্শক ফিরিয়ে আনা যায়, এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টরা। তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

কাজী ফিরোজ রশীদ

সাবেক সভাপতি, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি

ছবি কোথায়? আমার ৬টি সিনেমা হল। গোপালগঞ্জের মেরী হলটি বন্ধ করে দিয়েছি। বাকিগুলো কীভাবে রাখব ভাবছি। কারণ মানসম্মত না হওয়ায় ছবি কেউ দেখে না। অনুদানের ছবি চলে না, ভারতে মুক্তির পর ছবি আনা হয় বলে আগেই দর্শকের দেখা হয়ে যায়। ফলে সেই ছবি দেখতে সিনেমা হলে দর্শক আসে না। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে সিনেমা হল সংস্কার করেছিলাম। ছবি আর দর্শকের অভাবে এখন লোকসান গুনছি। ইংরেজি ছবি আসতে পারলে ভারতীয় বাংলা ছবির ক্ষেত্রে বাধা কেন? এসব নিয়ে ভাবতে হবে। মানসম্মত পর্যাপ্ত ছবি নির্মাণ করতে হবে।

 

সুদীপ্ত কুমার দাস

প্রধান উপদেষ্টা, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি

সিনেমা হল বাঁচাতে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি দরকার। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যৌথ প্রযোজনা আর চলচ্চিত্র বিনিময় ব্যর্থ হচ্ছে। সাফটা চুক্তির আওতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র বিনিময়ে অনুমতি দিলেও তথ্য মন্ত্রণালয় পূর্বশর্ত আরোপ করেছে। ২০১০-১২ বছরে সরকার উপমহাদেশের ছবি আমদানির অনুমতি দিয়ে ৬ মাস পর তা বন্ধ করে দেয়। এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরে ২০১২-১৫ বছরের জন্য ফের অনুমতি দেয়। এখন ২০১৬-১৮ এর জন্যও অনুমতি দিয়েছে। তা সত্ত্বেও তথ্য মন্ত্রণালয় কেন পূর্বশর্ত এবং এনওসির কথা বলে এই বিনিময় বাধাগ্রস্ত করছে। রপ্তানির ক্ষেত্রেও চলছে একই অবস্থা।  সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে উৎসবে ছবি আমদানি বন্ধ করা কতটা যৌক্তিক?

 

মিয়া আলাউদ্দীন

উপদেষ্টা, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি

সরকার সিনেমা হল সংস্কারে যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। কলকাতার সঙ্গে চলচ্চিত্র বিনিময়ের অধীনে বছরে যদি ১০টি ছবি একসঙ্গে দুই দেশে মুক্তি পায় তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তাও অকার্যকর হয়ে আছে। স্থানীয়ভাবে অল্প-স্বল্প ভালো ছবি মাঝেমধ্যে মুক্তি পেলেও পাইরেসি হয়ে যায়। সিনেপ্লেক্সের প্রসারও আমাদের এখানে সুদূর পরাহত। প্রজেক্টর ভাড়া নিয়ে অনেকে বিতর্ক তৈরি করছে। ৩৫ মিলিমিটারে যখন ছবি নির্মাণ হতো তখন প্রতি প্রিন্ট বাবদ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হতো। ডিজিটাল পদ্ধতি হওয়ায় সেই অর্থ বেঁচে গেছে। তাহলে প্রজেক্টর ভাড়া পরিশোধে সমস্য কোথায়?

 

মিশা সওদাগর

সভাপতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি

সিনেমা হল বাঁচাতে মানসম্মত ছবির বিকল্প নেই। মানুষের আয় বেড়েছে। তারা এখন সিনেমা হলের উন্নত পরিবেশ চায়। ছবির অভাবে কাকরাইল ফিল্মপাড়া আর এফডিসি বলতে গেলে মৃতপুরী। জনপ্রিয় প্রযোজনা সংস্থাগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। আছে হাতে গোনা কয়েকটি প্রযোজনা সংস্থা, তাও নির্মাণে অনিয়মিত। পেশাদার প্রযোজক, নিয়মিত পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি এবং সিনেমা হলের আধুনিকায়নই পারে সিনেমা হলকে বাঁচাতে। এখন বিশ্বব্যাপী সিনেপ্লেক্সের যুগ। তাই এ দেশে বেশি করে সিনেপ্লেক্সে নির্মাণ করতে হবে।

 

খোরশেদ আলম খসরু

প্রযোজক, প্রদর্শক

আমরা যদি নিজের দেশের চলচ্চিত্রের প্রতি মায়া না দেখিয়ে ভিনদেশি চলচ্চিত্রের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি তা হলে ভালো ছবি নির্মাণ হবে কীভাবে? সিনেমা হলের আধুনিকায়ন, ভালো গল্প, নির্মাণ, শিল্পী থাকলে চলচ্চিত্রের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। সিনেমা হলকে যদি কেউ প্রজেক্টর দিয়ে জিম্মি করে রাখে তাহলে নির্মাতা কেন লোকসান গুনে ছবি নির্মাণ করতে যাবে। সরকার বার বার আশ্বাস দিয়েও সিনেমা হল সংস্কার বা প্রজেক্টরের ব্যবস্থা করছে না। নির্মাতা আর্থিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলেই নির্মাণে আসবে। প্রয়োজনে সরকার সিনেমা হলের উন্নয়নে লোনের ব্যবস্থা করতে পারে।

 

আবদুল আজিজ

কর্ণধার, জাজ মাল্টিমিডিয়া

মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং সিনেমা হলের পরিবেশ উন্নয়নের কথা সবাই শুধু মুখেই বলে। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সিনেমা হলের উন্নয়ন করতে গিয়ে এই কঠিন সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছি। ভালো কাজ করতে গেলে নানা অজুহাতে পদে পদে বাধা তৈরি হয়। সহযেগিতার বড় অভাব। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যায়। বিশ্বায়ন ও উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির এই যুগে নিজেদের ঘরে আবদ্ধ করে রাখলে কি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারব? সিনেমা হলে প্রজেক্টর স্থাপন করলে তার ভাড়া তো দিতেই হবে। আমরা তো সিনেমা হল ভেদে খুব কম ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা করে ভাড়া নিচ্ছি। পার্শ্ববর্তী কলকাতায় এই ভাড়া ২২ হাজার রূপী। মোট কথা সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আর সহযোগিতা না থাকলে কোনো লগ্নিকারক এই খাতে অর্থ লগ্নি করতে আসবে না। এই বন্ধ্যত্বও কখনো কাটবে না।

 

মোস্তাফিজুর রহমান মানিক

চলচ্চিত্র নির্মাতা

সিনেমা হলে দর্শক ফিরিয়ে আনার পূর্বশর্ত হলো মানসম্মত নির্মাণ ও গল্প। যা পেলে দর্শক সিনেমা হলে যে যায় তার প্রমাণ একাধিকবার পাওয়া গেছে। যেমন মনপুরা, মোল্লাবাড়ীর বউ, আয়নাবাজী, ঢাকা অ্যাটাক, পোড়ামন টু এবং এই ঈদে আমার নির্মিত ‘জান্নাত’ ছবিটি দর্শক আগ্রহ নিয়ে দেখছে। কারণ ছবিটিতে তারা সময় উপযোগী গল্প ও আধুনিক নির্মাণ পেয়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় সিনেমা হলের পরিবেশ এ ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। বিশেষ করে মফস্বলে ভালো সিনেমা হলের অভাবে দর্শকচাহিদা থাকা সত্ত্বেও ছবিটি চাহিদামাফিক সিনেমা হলে মুক্তি দিতে পারিনি। এতে কিন্তু প্রযোজক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবস্থা কাটাতে সরকার এবং চলচ্চিত্রকারদের উদ্যোগ নিতে হবে।

সর্বশেষ খবর