সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সমিতি নিয়ে ব্যস্ত চলচ্চিত্রের সবাই

আলাউদ্দীন মাজিদ

সমিতি নিয়ে ব্যস্ত চলচ্চিত্রের সবাই

দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রের অবস্থা নাজুক হলেও চলচ্চিত্র সমিতিগুলোর কর্মতৎপরতায় টিকে আছে শিল্পটির অস্তিত্ব। এমন দাবি চলচ্চিত্রকারদের। চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান সংস্থা এফডিসিতে অবস্থিত রয়েছে চলচ্চিত্র সমিতির বেশ কয়েকটি অফিস। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, এফডিসিতে যদি সমিতির অফিস না থাকত তা হলে অনেক আগেই এই সংস্থাটি বিরান ভূমিতে পরিণত হতো। কারণ চলচ্চিত্রের কাজ কমে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটিতে চলচ্চিত্রের লোকজনের যাতায়াত একেবারেই কমে গেছে। সমিতির অফিস থাকায় অন্তত প্রতিদিন চলচ্চিত্রকাররা সংখ্যায় কম হলেও এখানে আসেন। আর নির্বাচন, বনভোজন, ইফতার পার্টি বা সমিতির অন্য কোনো অনুষ্ঠান হলে বিপুলসংখ্যক চলচ্চিত্রকারের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এফডিসি। মানে চলচ্চিত্র নীরব থাকলেও সরব রয়েছে চলচ্চিত্র সমিতি। ২৫ অক্টোবর চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন। আর এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন এফডিসিতে চলছে আনন্দ উৎসব। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এফডিসি থাকে লোকে লোকারণ্য।

নব্বই দশকের শেষ ভাগে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার জোয়ার, ২০০৮ সালের পর থেকে মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় চলচ্চিত্র শিল্প মূলত স্থবির হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে আবার পাইরেসি ও নকল ছবি নির্মাণ এই দুর্যোগকে আরও ঘনীভূত করে। আর এই সুযোগে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র আমদানির সুযোগ পায়। প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদের দাবি- স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি নির্মাণ নেই বলে সিনেমা হলমালিকরা লোকসান গুনে টিকতে না পেরে সিংহভাগ হল বন্ধ করে দিয়েছেন। যে হলগুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলো টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়ে উপমহাদেশীয় ছবি আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়েছে। এভাবেই সমিতির মাধ্যমে শিল্পটির অস্তি¡ত্ব রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির নির্বাচন না হওয়ায় এটি অচল ছিল বলে চলচ্চিত্রের দৈন্যদশা আরও বেড়েছে, এ দাবি চলচ্চিত্রকারদের। সম্প্রতি সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচিত কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর নবনির্বাচিত সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘সিনেমা হল ও ভালো ছবি নির্মাণ বাড়াতে কাজ করতে চাই। পাশাপাশি প্রখ্যাত যে প্রযোজকরা এখন আর কাজ করছেন না, তাদের পুঁজির নিশ্চয়তা দিয়ে ছবি প্রযোজনায় ফিরিয়ে আনতে চাই। একই সঙ্গে সিনেমা হলের প্রজেক্টরের ভাড়া যেন প্রযোজককে বহন করতে না হয় সে উদ্যোগ নিচ্ছি। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, নানা কারণে ছবি নির্মাণ উদ্বেগজনক হারে কমছে। গত দুই বছরের চিত্রই যদি ধরা হয় তাতে দেখা যায় ২০১৭ সালে মুক্তি পায় ৫৬টি দেশীয় ছবি। ২০১৮ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫টিতে। চলতি বছরের ৯ মাস অতিক্রম করতে চললেও এখন পর্যন্ত ৪০টি ছবিও মুক্তি পায়নি। অথচ নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বছরে শতাধিক ছবির মুক্তির রেকর্ড রয়েছে। আর এখন ছবি মুক্তি পেলেও শতকরা ৯৮টি ছবি মানের অভাবে দর্শকগ্রহণযোগ্যতা পায় না। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, ‘সমিতির কাজ ছবি নির্মাণ করা নয়। সংগঠনের সদস্যদের স্বার্থরক্ষা করা ও সেবা দেওয়া। এরপরও শিল্পী সমিতি চলচ্চিত্রকে ঘুরে দাঁড়াতে কাজ করে যাচ্ছে। সব সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে শিল্পী সমিতি ও পরিচালক সমিতি বাংলা ছবিকে বাঁচাতে কাজ করছে। কয়েকদিন আগেও সরকারের কাছে সহযোগিতা  চেয়েছি আমরা। আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। নতুন তথ্যমন্ত্রী চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছিলেন গত এপ্রিলে এফডিসিতে অনুষ্ঠিত চলচ্চিত্র দিবসের অনুষ্ঠানে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার আশ্বাসের সিকি ভাগও পূরণ হয়নি। আমরা এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চলচ্চিত্র শিল্পের দুর্দিন দূর করতে চাই। ভালো ছবি নির্মাণে শিল্পী সমিতি একক কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। সমষ্টিগত ভূমিকার সহায়ক হতে পারি আমরা। নিজেদের জায়গা থেকে শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, দক্ষতা বাড়ানো নিয়ে আমরা কাজ করব। অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শেখার চর্চা বাড়ানোর পরিবেশ আমরা  তৈরি করেছি। সামনের দিনগুলোতে আরও সুন্দর হবে সেই পরিবেশ। আর চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট অন্য সমিতিগুলোর সমন্বয়ে গঠিত চলচ্চিত্র পরিবারে আবদ্ধ হয়ে সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা সিনেমার সমস্যা দূর করতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গেও দেখা করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সিনেমার উন্নয়নে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। খুব শিগগিরই আমাদের সিনেমা নির্মাণেও পরিবর্তন আসবে। এরই মধ্যে এসেছেও। আর ভালো গল্প, ভালো নির্মাণে দর্শক মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র পাবেন।’ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘দিনশেষে ছবি নির্মাণ করতে হবে, এটাই একমাত্র সত্যি। তবে এটা মানতে হবে, সমিতিগুলো কিন্তু নিজেদের বিভিন্ন স্বার্থরক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে। চলচ্চিত্রের সংকট দূর করতে সমিতিগুলোর নিজ নিজ জায়গা থেকে চেষ্টা করতে হবে। সমিতির সদস্যরাই তো চলচ্চিত্রের অংশ।’ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘সিনেমার সংকট দূর করতে সমিতিগুলোকে সদস্যদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের সব সংকট দূর করতে নিজ নিজ জায়গা  থেকে চেষ্টা করতে হবে। চলচ্চিত্র পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা পরিচালক সমিতি আগে থেকেই নানা আন্দোলন করে সফল হয়েছি। যেমন আন্দোলন করে যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা সংশোধন, আমদানি-রপ্তানি ছবির সঠিক নিয়ম মানা ইত্যাদি। আগামীতে সবাই সম্মিলিতভাবে চলচ্চিত্রের উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখতে চাই। সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে চলচ্চিত্রের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে চাই।’ চলচ্চিত্র এডিটরস গিল্ডের সভাপতি আবু মুসা দেবু বলেন, ‘এই শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে সমিতিগুলো বরাবরই ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সমিতি না থাকলে শিল্পটি অনেক আগেই অস্তিত্বশূন্য হয়ে পড়ত। নানা কর্মকা-, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সদস্যদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে সমিতিগুলো। এখন সব সমিতি একত্রিত হয়ে কীভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও এই ব্যবসায় জোয়ার আনা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর