শনিবার, ২০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলা গানের কিংবদন্তি শাহনাজ রহমতুল্লাহ

বাংলা গানের কিংবদন্তি শাহনাজ রহমতুল্লাহ

‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়/যে ছিল হৃদয়ের আঙ্গিনায়, সে হারালো কোথায়/কোন দূর অজানায়,

সেই চেনা মুখ কতদিন দেখিনি/তার চোখে চেয়ে স্বপ্ন আঁকিনি।’ বাংলা গানে কিংবদন্তিতুল্য সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিজের গাওয়া এ গানের মতোই চিরদিনের জন্য সবার দৃষ্টিসীমার অন্তরালে হারিয়ে গেলেন। এ গুণী মানুষটিকে নিয়ে লিখেছেন- আলী আফতাব

 

দেশাত্মবোধক গানে এদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক কণ্ঠস্বর শাহনাজ রহমতুল্লাহ। তার গাওয়া কালজয়ী অজস্র জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান এখনো সর্বস্তরের বাঙালির প্রাণ স্পন্দিত করে। পরিচ্ছন্ন ও মায়াময় কণ্ঠস্বরের দিক থেকে বাংলা ভাষার শিল্পীদের মধ্যে শাহনাজ রহমতুল্লাহ নিজের স্বাতন্ত্রিক একটা পরিচয় তৈরি করেছিলেন। দীর্ঘ ৫ দশকেরও অধিক সময়ের ক্যারিয়ারে তার মধুঝরা কণ্ঠে রয়েছে অসংখ্য কালজয়ী গান। দেশের গান এবং চলচ্চিত্রের গানে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’-এর মতো প্রচুর জনপ্রিয় গান রয়েছে কিংবদন্তি এ কণ্ঠশিল্পীর গাওয়া। তার গাওয়া দেশাত্মবোধক ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’ বাংলা গানের ভুবনে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছে। দেশাত্মবোধক গানের জন্য সর্বসাধারণের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া চারটি গান স্থান পায়। যা আমাদের সংগীতকে করেছে অনন্য উজ্জ্বল ও শোভামন্ডিত। পাশাপাশি শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া অসংখ্য রোমান্টিক গানের মধ্যে ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছো তুমি’ ইত্যাদি আজও মানুষের মুখে মুখে ফিরে।

শাহনাজ রহমতুল্লাহ ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম এম ফজলুল হক ও মাতার নাম আসিয়া হক। শাহনাজের ভাই আনোয়ার পারভেজ দেশবরেণ্য সুরকার ও সংগীত পরিচালক এবং আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা ও গায়ক। পরিবারের সবার কাছে তিনি ছিলেন আদরের শাহীন। ছোটবেলা থেকেই শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। মূল নাম শাহনাজ বেগম হলেও পরবর্তীতে শাহনাজ রহমতুল্লাহ হিসেবেই সংগীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বাবার অনুপ্রেরণা আর মায়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একেবারে ছোটবেলায় শাহনাজের গানে হাতেখড়ি। বরেণ্য এ শিল্পী উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেন ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে। এরপর তিনি ওস্তাদ মনির হোসেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কাছেও গানে তালিম নেন। তিনি গজল শিখেছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি গজলসম্রাট মেহেদী হাসানের কাছে।

শাহনাজ রহমতুল্লøাহ মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেন। এরপর বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। ১৯৬৪ সাল থেকে টেলিভিশনে গাইতে শুরু করেন। তিনি গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলাউদ্দিন আলী, খান আতা প্রমুখের সুরে গান গেয়েছেন। পাকিস্তানে থাকার সুবাদে করাচি টিভিসহ উর্দু ছবিতেও গান করেছেন। সত্তরের দশকে অনেক উর্দু গীত ও গজল গেয়ে সংগীতপিপাসুদের মাতিয়েছেন শাহনাজ। সেসব গানে এখনো মানুষ মুগ্ধতায় ভাসেন। গানের জগতে ৫০ বছরেরও অধিক সময়ের সংগীত জীবনে শাহনাজ রহমতুল্লাহর চারটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। প্রথমটি ছিল প্রণব ঘোষের সুরে ‘বারটি বছর পরে’, তারপর প্রকাশিত হয় আলাউদ্দীন আলীর সুরে ‘শুধু কি আমার ভুল’। ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্তির পর গান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। এছাড়া গান থেকে বিদায় নেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ধর্মপরায়ণ জীবন বেছে নেওয়া।

 

ব্যক্তিগত জীবন

শাহনাজ রহমতুল্লাহ ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৭৩ সালে সেনা কর্মকর্তা আবুল বাশার রহমতুল্লাহর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ দম্পতির এক কন্যা ও এক পুত্র রয়েছে। স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবুল বাশার রহমতুল্লাহ একজন ব্যবসায়ী। মেয়ে নাহিদ রহমতুল্লাহ থাকেন লন্ডনে। আর ছেলে এ কে এম সায়েফ রহমতুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এখন কানাডায় থাকেন।

সর্বকালের সেরা যে চারটি গান

বিবিসি ২০০৬ সালের পুরো মার্চ মাসজুড়ে বাংলা গানের ওপর জরিপ চালিয়েছিল। সেখানে বাংলা গানের শ্রোতারা তাদের বিচারে সেরা যে পাঁচটি গান মনোনয়ন করেছেন, তার ভিত্তিতে বিবিসি বাংলা তৈরি করেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের তালিকা। সেই তালিকায় থাকা চারটি গানই রয়েছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া। তালিকার ৯ নম্বরে আছে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’ গানটি। এ গানটির গীতিকার ও সুরকার খান আতাউর রহমান। ১৩ নম্বর স্থানে আছে শাহনাজের গাওয়া ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি। এ গানের গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার ও সুরকার শিল্পীর বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ। এ গানটি স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনা সংগীত হিসেবে তৈরি করা হয় ১৯৭০ সালে। তালিকার ১৫ নম্বর গানটি ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’। শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া এ গানের গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার ও সুরকার আনোয়ার পারভেজ। ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’ গানটি রয়েছে ১৯ নম্বর স্থানে। এ গানটিও আনোয়ার পারভেজের সুরে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় গেয়েছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ।

 

প্রাপ্তি

অসংখ্য-অগণিত শ্রোতা-ভক্তের অমোঘ ভালোবাসা ছাড়াও তার প্রাপ্ত পুরস্কার-সম্মাননার তালিকাটাও বেশ লম্বা। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯২ সালে রাষ্ট্র তাকে সম্মানিত করেছে একুশে পদকে ভূষিত করে। এর আগে ১৯৯০ সালে ছুটির ফাঁদে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শাহনাজ রহমতুল্লাহ। এছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন কিংবদন্তি এ সংগীতশিল্পী।

 

জনপ্রিয় গান

শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘কে যেন সোনার কাঠি’, ‘মানিক সে তো মানিক নয়’, ‘যদি চোখের দৃষ্টি’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘খোলা জানালা’, ‘পারি না ভুলে যেতে’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি’, ‘আরও কিছু দাও না’ এবং ‘একটি কুসুম তুলে নিয়েছি’।

 

চলচ্চিত্রে গান

তিনি প্রচুর চলচ্চিত্রের নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছেন। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- গুনাই, ডাক বাবু, বেহুলা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, নয়নতারা, আনোয়ারা, রাখাল বন্ধু, সাত ভাই চম্পা, বাঁশরী, সুয়োরানী দুয়োরানী , পীচ ঢালা পথ, এতটুকু আশা, পরশমণি, মুক্তি, ভানুমতি, পাতালপুরীর রাজকন্যা, আলিঙ্গন, নীল আকাশের নীচে, বিজলী, মধুমিলন, আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী, কত যে মিনতি, রং বদলায়, বিনিময়, অধিকার, স্মৃতিটুকু থাক, জয় বাংলা, গান গেয়ে পরিচয়, বাহরাম বাদশাহ, অশ্রু দিয়ে লেখা, প্রতিশোধ, ঘুড্ডি, ছুটির ফাঁদে। বাংলা গানের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৩ মার্চ ২০১৯  নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। শারীরিকভাবে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও গুণী এ সংগীতশিল্পী আজীবন বেঁচে থাকবেন তার অনবদ্য সব কীর্তির মাঝে।

 

এক পরিবারের তিনজনই কিংবদন্তি

আনোয়ার পারভেজ, জাফর ইকবাল ও শাহনাজ রহমতুল্লাহ। নিজ নিজ নামে তারা তিনজনই পরিচিত। নিজস্ব গুণে সমৃদ্ধ করেছেন লাল সবুজের এ দেশের সংস্কৃতি। আনোয়ার পারভেজ সুর ও সংগীতায়োজন দিয়ে, শাহনাজ রহমতুল্লাহ গান গেয়ে এবং জাফর ইকবাল সিনেমায় অভিনয় ও গান গেয়ে জয় করেছেন বাংলার প্রতিটি মানুষের মন। হয়েছেন কিংবদন্তি। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে- আনোয়ার পারভেজ, শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও জাফর ইকবাল; তারা তিনজনই একই পরিবারের সন্তান। এম ফজলুল হক ও আসিয়া হকের সন্তান তারা। তার মধ্যে আনোয়ার পারভেজ সবার বড়, জাফর ইকবাল মেজ এবং শাহনাজ রহমতুল্লাহ সবার ছোট।

 

 

যে কারণে গান ছেড়ে দিয়েছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ

শাহনাজ চলে গেলেও রয়ে গেছে তার মধুঝরা কণ্ঠের কালজয়ী গানগুলো। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি গণমাধ্যামকে জানিয়ে দেন, ‘তিনি এখন ধর্ম-কর্মে বেশ মনোযোগী হয়েছেন। তাই গান করার সময় হয়ে উঠছে না।’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘আমার নামাজ পড়েই সময়টা বেশ কাটছে। ওমরাহ করে আসার পরদিন থেকেই আর গান করতে ইচ্ছা করেনি। তখন আমি নামাজ পড়া শুরু করেছিলাম। পবিত্র কাবা, মহানবী (সা.)-এর রওজা শরিফ দেখে আসার পর থেকে পার্থিব বিষয়ে আগ্রহী নন তিনি।’ মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কিছু ঘরোয়া অনুষ্ঠান ছাড়া এ গুণী শিল্পীকে আর দেখা যায়নি কোনো গানের অনুষ্ঠানে।

 

সর্বশেষ খবর