শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনাকালে বেকার শুটিংবাড়ি...

করোনাকালে বেকার শুটিংবাড়ি...

বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যতিব্যস্ত থাকে ঢাকার বেশির ভাগ শুটিং হাউস। অভিনয়শিল্পীদের শিডিউল মেলাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। তবে করোনাকালীন সব ব্যতিক্রম! স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিছু নাটকের শুটিং হয় কোরবানির ঈদ সামনে রেখে। পুবাইল, উত্তরার শুটিংবাড়িসহ অনেকে বাসাবাড়িতেও নাটকের শুটিং হয়। এদিকে শুটিং ব্যস্ততা কম থাকায় শুটিং হাউসের মালিকরা বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতিমধ্যে বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় কয়েকটি শুটিংবাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাকালীন এসব সমস্যা নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল

 

প্রতিবারই ঈদ সামনে রেখে প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল ৭ থেকে ১০ দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। এসব অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ অংশজুড়েই থাকে টিভি নাটক, ধারাবাহিক ও টেলিফিল্ম। রোজার ঈদের মতো এবারও কোরবানির ঈদে দেখা গেছে কিছুটা ব্যতিক্রম। এবার করোনা আতঙ্কে ঈদ অনুষ্ঠানমালায় টেলিভিশনে নতুন কনটেন্ট প্রচার হয়েছে কম। পুরনো-নতুনের মিশেলে ঈদ অনুষ্ঠানসূচি ছিল। ঈদের অনুষ্ঠানমালায় দেখা গেছে বিকল্প পরিকল্পনা। নতুন কিছু নাটকের সঙ্গে পুরনো নাটক প্রচার হয়েছে এবারও। ছিল কিছু সাত পর্বের খ- নাটক। তবে সরগরম ছিল ডিজিটাল প্ল্যাটফরম। ইউটিউবে অবমুক্ত হওয়া নাটকেই চোখ ছিল সবার। করোনা আতঙ্কে নাটক, টেলিফিল্ম, ওয়েব সিরিজের কাজ হয়েছে কম। অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও প্রযোজকদের ব্যতিব্যস্ততা তেমন ছিল না বললেই চলে।

রোজার ঈদের পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে নাটকের শুটিং শুরু হয়; কিন্তু কাজ শুরুর ঘোষণা আসার পর খুব বেশি আগ্রহ দেখা যায়নি অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতাদের। তবে লকডাউন তুলে নেওয়ার পর স্বল্প পরিসরে চলেছে ঈদ নাটকের শুটিং। আগে এক ঘণ্টার নাটকের শুটিং হতো ৩ থেকে ৪ দিন। তবে করোনার কারণে এবার শুটিং হয়েছে এক-দুদিনে। একটি বাড়িতেই নানা জায়গা ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে নাটক। নিরাপত্তার জন্য শুটিংয়ে যুক্ত হয়েছে বাড়তি খরচ। আগে এক নাটকের জন্য নানা জায়গায় শুটিং থাকত, এখন এক জায়গার মধ্যেই শুটিং করে নাটক বানানো হচ্ছে। নাটক নির্মাণের সময়, গল্প ও শিডিউলেও এসেছে পরিবর্তন।

এদিকে করোনার কারণে ২১ মার্চ থেকে মের শেষ পর্যন্ত শুটিং স্থগিত ছিল। এতে কোটি টাকার মতো লোকসান গুনতে হয়েছে ঢাকার শুটিং হাউসগুলোকে। ১ জুন থেকে শুটিং শুরু হলেও শুটিং হাউসে গিয়ে অনেক শিল্পীই কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। চ্যানেলে প্রচারের জন্য কিছু খন্ড নাটক, সাত পর্বের ধারাবাহিক বা টেলিফিল্মের কাজ শুরু হয়। তবে শুটিং হাউসে গিয়ে কাজ করা নিরাপদ মনে না করায় কিছু কাজ চলেছে বাসাবাড়িতে। এদিকে শুটিং ব্যস্ততা কম থাকায় শুটিং হাউসের মালিকরা বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতিমধ্যে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় কয়েকটি শুটিংবাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। শুটিং হাউসের মালিকদের সংগঠন শুটিং হাউস অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের ভাষ্য, কয়েক মাস শুটিং বন্ধ। ফলে প্রতি মাসে শুটিংবাড়ির ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন বাবদ পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা গুনতে হয়েছে। উত্তরার আপনঘর শুটিং বাড়ির মালিক ও সংগঠনের সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, ‘করোনার মধ্যে আমার চারটি শুটিংবাড়ির মধ্যে একটি বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি তিনটি বাড়িতে আগের মতো শুটিংয়ের ব্যস্ততা নেই। আর করোনাকালে আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এত কম কাজ দিয়ে শুটিংবাড়ি টিকিয়ে রাখা কঠিন।’

করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, কলাকুশলী, অভিনয়শিল্পী, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। এ কারণে সামনে খুব খারাপ সময় আসছে বলে টিভিসংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন। টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসির বলেন, ‘করোনা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এর জন্য পুরো টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির যে ক্ষতি হয়েছে আগামীতে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।’ বিগত বছরগুলোতে ঈদের আগে দিনরাত সমানতালে ব্যস্ত থাকত উত্তরার শুটিংবাড়িগুলো। চলত টানা শুটিং। মাসের অন্য সময়ে সেভাবে কাজ না থাকলেও ঈদের মৌসুমে মালিকরা পুষিয়ে নিতেন। কিন্তু গত ঈদে শুটিংই হয়নি, আর এ ঈদেও তেমন করে শুটিং হয়নি বলা চলে। কিছু নাটকের শুটিং হয়েছে পুবাইলে বা বাসাবাড়িতে। অনেকেই বাগানবাড়িতে গিয়ে টানা দু-তিন দিন শুটিং করে নাটক নির্মাণ করছেন। অনেকেই আবার শুটিংবাড়ি এড়িয়ে যাচ্ছেন খরচ কমানোর জন্য। ঢাকার মধ্যে নিজেদের বাড়ি বা অফিস ব্যবহার করে শুটিং শেষ করছেন। এমতাবস্থায় চ্যানেলগুলোতে এক ঘণ্টার নাটকের আগ্রহ অতটা থাকবে কিনা সন্দেহ সবার। ধারাবাহিক নাটকেরও আগ্রহ কমছে আগের চেয়ে। হাউসগুলোতেও শুটিং কমে যাচ্ছে।

জানা গেছে, করোনার কারণে নাটকপাড়ায় ক্ষতি কয়েকশ কোটি টাকা! নাটক নির্মাণ থেকে শুরু করে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া অবধি নাটকের বেশ কিছু কর্মযজ্ঞ থাকে। এর মধ্যে নাটক নির্মাণ, নানা মাধ্যমে নেই নাটকের প্রমোশন, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের বাজেটসহ যাবতীয় কিছু রয়েছে। করোনার কারণে সব কিছুই হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। ঈদকে ঘিরে যে নাটকগুলো নির্মিত হয় তার বাজেট বছরের অন্য সময় নির্মিত নাটকের চেয়ে বেশি থাকে। ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা অবধি বাজেট হয়। অ্যাভারেজে তিন লাখ টাকা করে ব্যয় হলেও এক হাজার নাটকের শুধু নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এছাড়া ইউটিউব ও ভিডিও স্ট্রিমিং সাইটের জন্য এখন নতুন নতুন কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে শুধু নির্মাণেই ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয় প্রত্যেক ঈদে। বাংলাদেশ শুটিং হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান জানান, ‘সব মিলিয়ে ৩০টি শুটিং হাউস রয়েছে ঢাকায়। আগে কাকে ভাড়া দেব এ নিয়ে হিমশিম খেতে হতো। এখন অবস্থা পুরোটাই উল্টো।’

স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে কয়েকজন নির্মাতা কিছুসংখ্যক অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু শুটিং হাউস বা বাসাবাড়িতে একাধিক নাটকের শুটিং করেছেন ঈদের আগে।

এ ছাড়া যারা এখনো কাজে ফেরেননি তারাও অল্প সময়ের মধ্যেই শুটিংয়ে ফিরবেন বলে জানা গেছে। তবে তারকা অভিনয়শিল্পীদের শুটিংয়ে ফেরা স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। আর নতুন স্বাভাবিক (নিউ নরমাল) সময়ে বদলে যাবে শুটিং সেটের চিরচেনা অনেক রীতি, অনেক অভ্যাস।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে জম্পেশ আড্ডায় পড়বে ভাটা। হবে না একসঙ্গে সবাই মিলে খাওয়া। শিল্পীদের সৌজন্য সাক্ষাৎ চলবে দূর থেকে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তারকাদের এখন থেকে মেকআপ আর কস্টিউমের পাশাপাশি বারবার দেখতে হবে স্যানিটাইজার, মাস্ক ও চশমা ঠিক আছে কিনা!

সর্বশেষ খবর