‘আসিতেছে তারকাবহুল ছবি ‘দূরদেশ’....দর্শক অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাবেন একঝাঁক তারকার ছবি, গল্প আর গানের ছবি প্রখ্যাত নির্মাতা তারকা গড়ার কারিগর এহতেশাম নির্মিত ‘দূরদেশ’...।’ আশির দশক পর্যন্ত এভাবেই নির্মিত হতো তারকাবহুল ছবি। মানে একটি ছবিতে থাকত একাধিক সুপারস্টারের প্রতিযোগিতামূলক মনকাড়া অভিনয়। একেকজন দর্শক তাদের পছন্দের একেক তারকাদের দেখতে সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। প্রিয় তারকাদের মনোমুগ্ধকর অভিনয় দেখে পরম তৃপ্তি নিয়ে সিনেমা হল থেকে বের হতেন। শুধু একবার নয়, বারবার ছবিটি দেখতেন। এভাবেই একটি ছবি হিট হয়ে যেত। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘দেশীয় চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তনের পর থেকে আশির দশক পর্যন্ত এ দেশে মাল্টি স্টার কাস্টিংয়ের ছবি নির্মাণ হতো। সেসব ছবির প্রতি দর্শক আকর্ষণও থাকত আকাশছোঁয়া। তখন ছবি সফল হওয়ার অন্যতম কারণও ছিল এটি একটি। নব্বই দশক থেকে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করলে ছবির বাজারে ধস নামার এটিও একটি কারণ।’ স্বাধীন দেশে প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি ‘মানুষের মন’ ছিল তারকাবহুল ছবি। এতে অভিনয় করেন রাজ্জাক, ববিতা, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদসহ অসংখ্য তারকা। মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এই ছবির কাহিনি ও সংলাপ রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন মোস্তফা মেহমুদ। চলচ্চিত্রটি ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায়। এরপর অসংখ্য তারকাবহুল ছবি নির্মাণ হতে থাকে এবং ছবিগুলো সিনেমা হলে দর্শকদের চুম্বকের মতো টেনে নিত। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ বলেন, তারকাবহুল চলচ্চিত্র শুধু যে দর্শকদের কাছে আনন্দের ছিল তা নয়, এমন ছবিতে যেসব তারকা অভিনয় করতেন তারা ছিলেন একেকজন সুপারস্টার। তারা ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে রীতিমতো ভালো কাজ করার চ্যালেঞ্জে নেমে পড়তেন। এতে প্রতিযোগিতার কারণে সবার সেরা কাজটি পাওয়া যেত। এই কারণে ছবিটি দারুণভাবে সফল হতো। আসলে প্রায় আশির দশক পর্যন্ত ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি লক্ষণীয় ছিল তা হলো কীভাবে একটি ভালো গল্পের দর্শক গ্রহণযোগ্য ছবি নির্মাণ করা সম্ভব হয় তাই ছিল নির্মাতাদের ধ্যানজ্ঞান। এ অবস্থার যখন অবসান হলো তখনই ছবির ব্যবসায় খরা নামল। আশির দশক পর্যন্ত যেসব তারকাবহুল ছবি মুক্তি পেয়ে ব্যবসা সফল হয়েছে ও দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তার সংক্ষিপ্ত একটি ছবির চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো- মানুষের মন, জীবন থেকে নেয়া, আবার তোরা মানুষ হ, ওরা ১১ জন, অরুণ বরুণ কিরণ মালা, অতিথি, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, কে আসল কে নকল, বন্ধু, অংশীদার, জিঞ্জির, রাম রহিম জন, সূর্যকন্যা, অনুরাগ, তিন কন্যা, সন্ধি, স্বাক্ষর, লাঠিয়াল, দোস্ত দুশমন, বধূবিদায়, অবুঝ মন, ফকির মজনু শাহ, ঘর সংসার, বৌরানী, সোহাগ, সখী তুমি কার, চাঁদ সুরুজ, দূরদেশ, শুভদা, মায়ের দোয়া, সত্য মিথ্যা, সত্যের মৃত্যু নেই, রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত, ভাই বন্ধু, মেয়েরাও মানুষ, আমি সেই মেয়ে-সহ আরও অনেক ছবি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে মুক্তি পায় মাল্টি স্টার কাস্টিংয়ের ছবি ‘জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার’। এফ আই মানিক পরিচালিত এই ছবিতে অভিনয় করেন নায়করাজ রাজ্জাক, সোহেল রানা, আলমগীর, সুচরিতা, শাকিব খান, পূর্ণিমাসহ অনেকে।
কেন এখন তারকাবহুল ছবি নির্মাণ হচ্ছে না? এমন প্রশ্নে প্রখ্যাত নির্মাতা হাফিজউদ্দীন বলেন, আসলে এর কারণ অনেক, যেমন আগের শিল্পীদের মধ্যে প্রফেশনাল এবং চ্যালেঞ্জিং বিষয়টি শতভাগ ছিল। তাই সুপারস্টাররা একসঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এখন শিল্পীদের মধ্যে এই সাহস ও আত্মবিশ্বাসের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, নানা কারণে সিনেমা হলের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে ছবির বাজার সংকুচিত হওয়ায় বিগ বাজেট নিয়ে ছবি নির্মাণে এগিয়ে আসতে নির্মাতারা ভয় পান। কারণ সিনেমা হলের সংখ্যা কম থাকায় লাভ তো দূরের কথা মূলধনই ফেরত আনা সম্ভব নয়। চিত্রপরিচালক দেবাশীষ বিশ্বাস দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার শ্রদ্ধেয় বাবা দিলীপ বিশ্বাস নির্মিত নায়করাজ রাজ্জাক, সোহেল রানা, আলমগীর আঙ্কেল অভিনীত বাম্পার হিট ছবি ‘জিঞ্জির’ রিমেক করতে চেয়েছিলাম, এই সময়ের প্রথম সারির তিনজন নায়কের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু তারা কেউই কারও সঙ্গে অভিনয় করতে রাজি হননি। তাদের কথায় অমুক থাকলে আমার ক্যারেক্টার হাইলাইট হবে না। তাই আমি এ ছবিতে কাজ করতে চাই না। দেবাশীষ বিশ্বাস ক্ষোভের সঙ্গে বলেন- অথচ আগের সুপারস্টারদের মধ্যে এমন হীনমন্যতা ছিল না। ফলে গল্প ও চরিত্র প্রধান দর্শক পছন্দের তারকাবহুল ছবি নির্মাণ সম্ভব হতো। যা এখন শুধুই কল্পনা। এ কারণেই ছবির বাজার এ দেশে ধ্বংস হয়ে গেছে।