সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

যেমন ছিল ঈদের নাটক ও ধারাবাহিক

যেমন ছিল ঈদের নাটক ও ধারাবাহিক

ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে তুলতে ছুটির দিনগুলোতে ভালো নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারের প্রতিযোগিতায় নামে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল। তারা পাঁচ থেকে আট দিন পর্যন্ত টানা ঈদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ ঈদে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে অসংখ্য নাটক ও টেলিছবি।  এসব নাটকের ভালো-মন্দ নিয়ে লিখেছেন - আলী আফতাব

প্রতি বছরের মতো এবারও প্রায় প্রতিটি চ্যানেলই সপ্তাহব্যাপী আয়োজন করেছে ঈদের অনুষ্ঠান। একক নাটক, টেলিফিল্মের পাশাপাশি ছিল ধারাবাহিক নাটকের আয়োজন। কিন্তু এসব নাটক আসলে দর্শকদের কথা চিন্তা করে প্রচার করা হয় কি না সেটাও ভাবার সময় এসেছে। কারণ সারা বছর দর্শক ধারাবাহিক নাটক দেখেন। ঈদের সময়ও যদি তাদের সেই ধারাবাহিক নাটকই দেখতে হয় তবে ঈদ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যান্য বছরের মতো এ ঈদে চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে নাটকের প্রাধান্য ছিল। পাশাপাশি চ্যানেলগুলো চেষ্টা করেছে ভিন্নধর্মী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচার করে দর্শক টানতে। অসংখ্য নাটক ও টেলিফিল্মের ভিড়ে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের সংখ্যা খুব উল্লেখযোগ্য ছিল না বললেই চলে। গত কয়েক বছরের ঈদ অনুষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায়, এবারের ঈদেও প্রচারিত নাটক ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে আহামরি নতুনত্ব দেখা যায়নি। তবে হানিফ সংকেতের রচনা ও পরিচালনায় ঈদের বিশেষ নাটক ‘যুগের হুজুগে’ নাটকটি ছিল আলোচনায়। অন্যদিকে ধারাবাহিক নাটকগুলোর প্রতিটি পর্বের মূল কাহিনির সম্প্রচার সময় গড়ে ১৫ মিনিট করে মোট ছয় পর্বে দেখানো হয় ৯০ মিনিট, যা একটি টেলিফিল্মের দৈর্ঘ্যরে কাছাকাছি। এ জন্য টেলিভিশনের কর্তাব্যক্তিরা ধারাবাহিক নাটকগুলোকে টেলিফিল্মের দৈর্ঘ্যে নির্মাণ করে প্রচারের উদ্যোগী হতে পারেন। ঈদে বিষয়ভিত্তিক ও সিরিয়াস ঘরানার কিছু নাটক প্রচারিত হয়েছে, যে নাটকগুলো দর্শক দেখেছেন এবং বোদ্ধাদের প্রশংসা পেয়েছে। এখনকার নাটকগুলোতে উৎসবকেন্দ্রিক ফ্লেভার সে রকমভাবে প্রকাশ পায় না বললেই চলে। আর কমেডি বলতে এখন যেসব নাটক নির্মাণ হয় তা দেখে হাসির পরিবর্তে দর্শকরা বিরক্তই হন। বলা যায়, সামাজিক সচেতনতামূলক নানা মেসেজ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই বিটিভিতে কমেডি নাটকের যাত্রা শুরু হয়। সময়ের বিবর্তনে আমাদের টিভি নাটকে যুক্ত হয়েছে নানা রকম ধারা। এর মধ্যে অন্যতম হলো-নাটকে কমেডির ব্যবহার। আর এ ধারার নাটকের মাধ্যমে যত সহজে সামাজিক, রাজনৈতিক নানা অবক্ষয় স্যাটায়ারের মাধ্যমে তুলে ধরা সম্ভব, অন্য ধারার নাটকে তা এভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু বিটিভির শুরুর দিকে নির্মাতারা যতটা যত্ন নিয়ে কমেডি নাটক নির্মাণ করতেন, পরবর্তী সময়ে আর তেমনটি দেখা যায়নি। বিশেষ করে স্যাটেলাইট চ্যানেল আসার পর আমাদের টিভি নাটকে কমেডির ব্যবহার অনেক সহজ বস্তুতে পরিণত হয়। গেল কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কমেডি নাটকের নামে যা প্রচারিত হচ্ছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দর্শকদের বিরক্তি সৃষ্টি করছে। কোনো কোনো নির্মাতা হাসির নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে হয়তো নিজেই হাসছেন, কিন্তু দর্শকদের হাসাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর যারা একবার তাদের নাটকের সংলাপ ও বিষয়বস্তু দিয়ে দর্শকদের হাসাতে সফল হননি, পরবর্তী সময়ে তারা দর্শকদের নাটকের মাধ্যমে কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া অনেক সময় এমনও দেখা গেছে যে, কোনো কোনো নির্মাতা হাসির নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে দর্শকদের হাসানোর উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন অশোভন দৃশ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। এসব কারণে এক সময় যেসব নির্মাতা হাসির নাটক নির্মাণ করে খ্যাতি লাভ করেছেন তারাও আজ কমেডি নাটক নির্মাণ থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন।

এ প্রসঙ্গে আবুল হায়াত বলেন, ‘সেই একই গল্প, একই মুখ ঘুরেফিরে এসেছে। দর্শকদের অভিযোগ ছিল, একঘেয়েমিতে ভুগেছে। তবে ভালো কিছু নাটকও হয়েছে।’

অন্যদিকে প্রবীণ অভিনেতা হাসান ইমামও মনে করেন ‘একইরকম’ নাটক হচ্ছে। তবে বরাবরের মতো ঈদে ভালো নাটকের অভাব রয়ে গেছে। দর্শক বিরক্তির কারণ হিসেবে তিনি ‘অতিরিক্ত’ বিজ্ঞাপনের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এ অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের অভিযোগটিও পুরনো হয়ে গেছে। এ অভিযোগটি এতই তীব্র যে অনেকেই বলেন, নাটকের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখি না, বরং বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক দেখি! যার কারণে অনেকেই বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে নাটক দেখতে চান না। কেবল নাটক নয়, অন্য অনুষ্ঠানগুলোতেও একই সমস্যা। ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ঝোঁকার এটিও একটি কারণ। বিজ্ঞাপনের আধিক্যজনিত সমস্যা ভয়াবহ হলেও এ সমস্যার সমাধান সেভাবে মেলেনি। তবে আশার কথা হলো, অনেক টিভি চ্যানেলই কিছু কিছু বিরতিহীন নাটক পরিবেশন করেছে। নাটক নিয়ে সচেতন দর্শকের আরও অভিযোগ রয়েছে। ভাঁড়ামি আর শিল্প এক বিষয় নয়। অথচ অনেক নাট্যনির্মাতা এ দুয়ের পার্থক্য বুঝতে পারছেন না। তারা দর্শকের কাছে ভাঁড়ামিকেই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরছেন। যেখানে নাটক দর্শকরুচি নির্মাণে কাজ করার কথা সেখানে এখন অনেক নাটকই দর্শকরুচিকে

নিম্নদিকে ধাবিত করছে। একশ্রেণির নাটকে ভাষার বিকৃতি বাড়ছে। বাড়ছে ‘কাতুকুতু’ দিয়ে দর্শক হাসানোর প্রবণতা। এটি খুবই দুঃখজনক। নাট্যকার থেকে শুরু করে নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই সাধারণ মানুষ নন। তাদের সামাজিক দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রত্যেক শিল্পীরই তাদের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা উচিত। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, সাধারণ দর্শক তো এসব নাটক নিচ্ছে। তারা উপভোগ করছে। সমস্যা কী? আমাদের কথা হলো- দর্শক যা দেখতে চায় তা দেখানো কি নাট্যকারের কাজ? নাটকের অভিপ্রায়? নাকি নাট্যকার ও নাটকের নিজস্ব গতিপথ এবং অভিরুচি রয়েছে? নাট্যকারের রুচিই যদি দর্শকরুচি হয় তবে সেখানে বলার কিছু থাকে না। কেননা, এ দৃষ্টিতে নাট্যকার ও জনতা একই কাতারের মানুষ। দর্শকের একাংশ ভাঁড়ামি নিচ্ছে বলে নাট্যকার সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন, অনেক দর্শক অশ্লীল বিষয়ও দেখতে আগ্রহী। তাহলে নাট্যকার বা নির্মাতা কি সেগুলোও দেখাবেন? দর্শক দেখতে চায় বলে দায়িত্ব এড়ানো যায় না। কেননা, এতে নাট্যকারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। নাট্যকারের ভাবা উচিত, দর্শক যা দেখতে চায় আমি কি তাদের সেটা দেখাব। নাকি আমি কী দেখাতে চাই তা দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করব।

আজকালের অনেক নাটকে গল্প থাকছে না। অথচ সুন্দর একটি গল্প নাটকের প্রাণ। গল্প ভালো না হলে পরিচালক, অভিনেতা সবাই চেষ্টা করেও একটি সুন্দর নাটক দর্শকদের উপহার দিতে পারেন না। তাই নাটকের জন্য ভালো গল্পের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নাটকে সাহিত্যনির্ভরতা বাড়াতে হবে। আমাদের প্রবীণ লেখকদের কাছ থেকে নাটকের জন্য গল্প নেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি নাটকই স্বতন্ত্র। তাই নাটকে নাটকে পার্থক্য থাকবে। গল্পগুলো আলাদা হবে। অনেক নাট্যকারকে একই গল্প ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। টিভি চ্যানেল, প্রযোজকদেরও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।   তাহলেই আমরা দর্শকনন্দিত ও আলোড়িত আরও  নাটক দেখতে পারব।

সর্বশেষ খবর