রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
কপিরাইট আইন সংশোধন নিয়ে প্রযোজকদের ক্ষোভ

আশার বাণী কপিরাইট বোর্ডের

আলী আফতাব

আশার বাণী কপিরাইট বোর্ডের

শিল্পী, গীতিকার, সুরকার এবং অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানদের স্বার্থ রক্ষার্থে শুরু থেকেই কাজ করে আসছে বাংলাদেশ কপিরাইট বোর্ড। মাঝে-মধ্যে এ নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীনও হতে হয়েছে তাদের। অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন আজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে লেখক-শিল্পীদের পাশাপাশি বড় অবদান রয়েছে পৃষ্ঠপোষক তথা প্রযোজক-পরিবেশকদের। এই প্রযোজকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা এবং উদ্যোগে দেশের সংস্কৃতি যখন হাঁটছে বৈশ্বিক পথে- তখনই সামনে এসে দাঁড়াল কিছু শঙ্কা।

প্রযোজকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সংশোধিত কপিরাইট আইনে তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তার চেয়ে বড় ক্ষোভ, আইনটি পরিবর্তন-পরিমার্জন করার বিষয়ে প্রযোজকদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। এর বাইরেও অনেক সম্ভাব্য বিধান নিয়ে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ। অন্যদিকে কপিরাইট বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে অন্য কথা। তারা বলছেন- আমরা কাজ করছি শিল্পী, গীতিকার, সুরকার এবং অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার্থে।   

জানা গেছে, এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে কপিরাইট আইন ২০২১-এর খসড়া। যা শিগগিরই পাস হবে। তবে তার আগেই এই আইন নিয়ে তুমুল ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন খোদ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর নেতা ও সদস্যরা। তাদের অভিমত, নতুন কপিরাইট আইনের মাধ্যমে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। ডিজিটাল মাধ্যমে নাটক, সিনেমা ও গান প্রকাশে তৈরি হবে নানা প্রতিবন্ধকতা। যা দেশ তথা ইন্ডাস্ট্রির জন্য সুখকর বার্তা বয়ে আনবে না।

এ প্রসঙ্গে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর প্রধান এবং লেজার ভিশনের অন্যতম কর্ণধার এ কে এম আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা যারা নিয়মিত কাজ করছি, তাদের সবকিছুই তো চলমান কপিরাইট আইনের ভিত্তিতে চলছে। কিন্তু আপত্তিটা নতুন আইনের কিছু সংশোধনী নিয়ে। যেটা মোটেই কাম্য নয়। আমার কথা, যার বা যাদের গান তারা যদি আমার চুক্তিপত্রে হাসিমুখে স্বাক্ষর করেন, সেটিতে অন্য পক্ষের হস্তক্ষেপ কেন থাকবে? ফলে নতুন যে আইনটি হচ্ছে সেটি আরও প্রপারলি, স্পষ্ট ও সংস্কৃতিবান্ধব হওয়ার দাবি জানাই।’ 

এদিকে দেশের আরেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুল বলেন, ‘এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছি। মামলা খেয়েছি, জেলও খেটেছি। নতুন আইন পাস হলে মামলা আমাদের পিছু ছাড়বে না। এভাবে এই আইন পাস হলে আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে।’

যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই- এই ঐতিহাসিক গানের রচয়িতা, চেনাসুর-এর কর্ণধার ও এমআইবির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসান মতিউর রহমান নতুন কপিরাইট আইন প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের অর্থায়নেই গড়ে উঠেছে অডিও শিল্প। তবুও আমরা কখনো বলিনি সবকিছু আমাদের দিয়ে দিন। বরাবরই চেয়েছি, একসঙ্গে থেকে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে এগিয়ে যেতে। কিন্তু বারবার সেই অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। হতাশার বিষয়- এমন একটি আইন হচ্ছে, যেটা সম্পর্কে আমরা এখনো পুরোপুরি অন্ধকারে আছি। আমরা জানি না, এই আইনে আসলে কী আছে, কী নেই। আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে আমরা এটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই, এটুকুই দাবি করছি।’

দেশের অন্যতম সংগীতশিল্পী ও ধ্রুব মিউজিক স্টেশনের কর্ণধার ধ্রুব গুহ বলেন, ‘বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যে কোনো আইন সংশোধন হতে পারে। কিন্তু তার আগে এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলে নেওয়া ভালো। নতুন আইনের কারণে যদি প্রযোজক-পরিবেশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে পুরো ইন্ডাস্ট্রিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চলচ্চিত্রভিত্তিক দেশের প্রাচীন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অনুপম রেকর্ডিং মিডিয়া। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও এমআইবির সহসভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন নতুন কপিরাইট আইন নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। বলেন, ‘চার দশকের প্রতিষ্ঠান আমার। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও গানের বিকাশে কাজ করার। অথচ এই পর্যায়ে এসে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। বর্তমানে যে আইন হচ্ছে বলে শুনছি, তাতে করে গান করার ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলছি।’

এ প্রযোজকের দাবি, ‘যারা এই মাধ্যমটির অপরিহার্য অংশ, তাদের ছাড়া কীভাবে কপিরাইট আইনের সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়, তা আমাদের বোধগম্য নয়। সব পক্ষকে নিয়ে একটি নির্মোহ আইন তৈরি করা দরকার।’

অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানদের ক্ষোভের মুখে আশার কথা জানালেন জাফর রাজা চৌধুরী-কপিরাইট  রেজিস্ট্রার, কপিরাইট বোর্ড। তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়টি নিয়ে এর আগে অনেকবার শিল্পী, গীতিকার, সুরকার এবং অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। এই সংশোধনী নিয়ে তাদের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আইন সংশোধিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। আগে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন, এখন সেটা চলে এসেছে মোবাইল ফোনে। আগে গান শুনতাম ক্যাসেট  প্লেয়ারে, এখন তা শুনি অনলাইনে। সময় পরিবর্তন হয়েছে, আইন কেন পরিবর্তন হবে না। আমাদের এই আইনটা ২০১৮ সালেই পাস হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানদের নানা বাধার মুখে আইনটি এত দিন পাস হয়নি।’

যে কোনো নতুন আইন মানুষের মনে আশার আলো জাগায়। কারণ, সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষার জন্যই আইনের সৃষ্টি। অথচ সেই সংশোধিত খসড়া আইন নিয়েই সংগীত প্রযোজক-পরিবেশক সংশ্লিষ্টরা আতঙ্কগ্রস্ত। প্রযোজকদের আবেদন, এ আইন প্রণয়নের আগে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে যেন চূড়ান্ত করা হয়।

সর্বশেষ খবর