শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : খুরশিদ আলম

আমি কখনো কমিটমেন্ট ভঙ্গ করি না

১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্রের গান দিয়ে জনপ্রিয়তা পান জীবন্ত কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম। এখন চলচ্চিত্রের গানে তেমন ব্যস্ত না থাকলেও ছোট পর্দা আর মঞ্চে গান গেয়ে চলেছেন সমান শ্রোতাপ্রিয়তা নিয়ে। এই কিংবদন্তি শিল্পীর অল্প করে গানের গল্প তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

আমি কখনো কমিটমেন্ট ভঙ্গ করি না

গান নিয়ে কেমন আছেন?

অনেক ভালো আছি। এখনো টিভি চ্যানেলসহ নানা অনুষ্ঠানে আমাকে গান করার জন্য ডাকা হয়, এর চেয়ে বেশি ভালো থাকা আর কাকে বলে। গত শনিবার মাছরাঙা টিভিতে ‘তোমায় গান শোনাবো’ অনুষ্ঠানে লাইভ গাইলাম। রবিবার অভিনেতা প্রয়াত রাজ্জাক সাহেবের মৃত্যুবার্ষিকীতে চ্যানেল আই আয়োজিত ‘গান দিয়ে শুরু’ প্রোগামে গাইলাম, এভাবে ব্যস্ততার মাঝেই এখনো সুন্দর সময় পার করছি।

 

চলচ্চিত্রের গান দিয়ে আপনার জনপ্রিয়তা শুরু, এই মাধ্যমে এখন কেমন ব্যস্ত?

দেখুন, এখন বছরে কয়টা মানসম্মত গল্প ও গানের ছবি হচ্ছে যে, আমাদের মতো সিনিয়র শিল্পীদের দিয়ে গাওয়াবে। এখন গানে গভীরতা বলে কিছু নেই। এ জন্যই কালজয়ী নয়, ক্ষণস্থায়ী হয় এখনকার গান। আগে একটি গান তুলতে প্রচুর সময় লাগত। আর এখন এক বসায়ই গান লেখা, সুর দেওয়া, গাওয়া হয়ে যাচ্ছে। মানে গান সৃষ্টি করা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।  সহজ হয়ে যাওয়া জিনিসের গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব খুবই কম। এভাবে তো সৃষ্টিশীল কাজ হয় না।

 

তাহলে এখনকার শিল্পীদের নিয়ে কী বলবেন?

এখনো অনেক ভালো গীতিকার, সুরকার আর শিল্পী আসছে। টেকনিক্যাল সাপোর্টেরও উন্নতি হয়েছে। তবে একজন গুরু বা অভিভাবকের খুবই অভাব চলছে। সংগীত হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। গুরু ছাড়া প্রকৃত সংগীত কখনো হয় না। এখন ঘরে ঘরে ইউটিউব। এ মাধ্যমে সহজে গান গেয়ে ইউটিউবে আপলোড করা যাচ্ছে। কয়েক বছর পর এখান থেকে একজন শিল্পী ডলার আয় করতে পারবে। আসলে আমাদের দেশে এখন যন্ত্রশিল্পীর খুব অভাব। যন্ত্রশিল্পীদের মাধ্যমেই একজন শিল্পীর গানের মাধুর্য ছড়ায়। শুধু কিবোর্ড দিয়ে তো  আর প্রকৃত গান হয় না। তাই সৃষ্টির পরপরই হারিয়ে যাচ্ছে এমন গান।

 

কীভাবে অবস্থার উন্নয়ন হতে পারে?

দেখুন, সংগীত আর খেলাধুলার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে চর্চার ওপর। এখন যারা গান গায় তাদের মধ্যে বেশির ভাগই গীতিকার ও সুরকারের নাম জানে না। তাদের মধ্যে গান নিয়ে চর্চার কোনো আগ্রহ নেই। এভাবে চললে তো গানের উন্নয়ন কখনই হবে না।। আগেই বলেছি, গান হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা, সত্যিকারের শিল্পী হতে গেলে অবশ্যই গুরুর দীক্ষা লাগবে।

 

সংগীত জীবনে আপনার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব কেমন?

সত্যি বলতে অপ্রাপ্তি আসে অতৃপ্তি থেকে। আমার হয়তো বাড়ি-গাড়ি নেই, আসলে ভাগ্যে না থাকলে ধনসম্পদ হয় না। তাতে কী হয়েছে, সেই সত্তরের দশক থেকে গাইছি। মানুষ এখনো আমাকে মনে রেখেছে। এই বয়সেও শারীরিকভাবে সুস্থ আছি, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে। আসলে প্রাপ্তি আসে ধৈর্য থেকে। আমি খুব সুখী মানুষ, আমার জীবনে অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই।

 

গান নিয়ে কোনো স্মৃতি কি আছে?

মনে পড়ে ‘একমুঠো ভাত’ ছবির মহরত অনুষ্ঠানের কথা। এখন যেমন কোনো ছবির মহরতে গ্লামারাস  কোনো মেয়ে বা মডেলকে নিয়ে দু-একজন ছেলে আর্টিস্টকে উপস্থিত রেখে হার্ডলি ২৫ জন মানুষের উপস্থিতিতে একটা ছবির মহরত অনুষ্ঠান হয়। আগে কিন্তু বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার মতো দীর্ঘ সময় কার্ড বিলি করে ৫০০ মানুষের উপস্থিতির আয়োজন করা হতো। তারপর ছবির মহরত অনুষ্ঠান হতো। ‘একমুঠো ভাত’ ছবির মহরতের দিন, আমার দাদি অনেক অসুস্থ। ডাক্তার বলছেন দাদিকে তাঁর পরিচিত মানুষজনের কাছে রেখে আসতে। তাহলে হয়তো তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমি দাদিকে আমাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ছবির পরিচালক ইবনে মিজান সাহেবকে বললাম আমি সন্ধ্যা ৭টার আগেই চলে আসব। যদিও মিজান সাহেব বললেন, অনুষ্ঠানটা ক্যান্সেল করে দিই। কিন্তু আমি বললাম, দেখেন ফিল্মে একটা কথা আছে, যদি প্রথম কোনো ফিল্মে কোনো নায়িকা সে যত সুন্দরী এবং ভালো অভিনেত্রীই হোক না কেন ফ্লপ করলে পরবর্তীতে যত ভালো কাজই করুক না কেন তা আর জনপ্রিয়তা পায় না। তো আমি যে করেই হোক সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে পৌঁছাব। আমি ঠিক সন্ধ্যা ৭টার ১৫ মিনিট আগে উসকো-খুসকো চুলে কাকরাইলে স্টুডিতে হাজির। মিজান সাহেব আমার অবস্থা দেখে বললেন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতে। কারণ তখনো অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। আমি তখন পল্টনে থাকতাম। ফ্রেশ হয়ে এসে ‘শোন ভাইয়েরা কথা শোন, এমন একজন মানুষ যে পাপ না করেছ’ গানটির রেকর্ড হলো। গানটি হিট করেছিল। তো কমিটমেন্টটা হলো অনেক বড় ব্যাপার। আমি কথা দিলাম, সেটা রাখতে পারছি। এই যে কমিটমেন্ট রাখতে পারা এটিই আমার কাছে এখনো সুখের স্মৃতি হয়ে আছে। আমি কখনো কমিটমেন্ট ভঙ্গ করি না।

 

মঞ্চে গান করার কোনো স্মৃতি কি আছে?

একবার কুমিল্লায় কোনো একটা মেয়েদের স্কুলে গান করতে গেলাম। গান করার পর স্টেজ থেকে নেমে এলাম। একটি মেয়ে এসে আমাকে বলল, ‘দেখুন আমি আপনার একজন বড় ভক্ত। কিন্তু আপনি ‘তোমার দু হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম’ গানটি করবেন না। এ সব আজেবাজে ফালতু গান করবেন না আপনি।’ তো আমি আবার মজা করে বললাম, ‘কি ব্যাপার ছ্যাঁকট্যাক খাইছ নাকি।’ মেয়েটি বলল, ‘তা আপনার জানার দরকার নাই।’ এই ব্যাপারটা এখনো খুব মনে পড়ে।

 

জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কোন সময়টা বা কোন গান।

যদি গান শেখার কথা বলি তাহলে বলব, যে সময়টায় সমর দাশ আমাকে শেখালেন। সেই শিক্ষাটাই আমার গান গাওয়ার স্টাইলকে বদলে দিয়েছিল, যা পরবর্তী সময় খুব কাজে এলো। দ্বিতীয়ত, প্রথম যে গানটি রুনা লায়লার সঙ্গে গাইলাম। ‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার, ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন’- এই গানটি আমাকে এতটাই জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল যে, কেউ ভাবেইনি এই গানটি এত হিট করবে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গান করছি এখনো।

সর্বশেষ খবর