সৈয়দ আবদুল হাদী। বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী। জাতীয়সহ অজস্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক। ষাটের দশক থেকে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা নিয়ে গেয়ে চলেছেন তিনি। তাঁর শ্রোতাপ্রিয়তায় এখনো এতটুকু ভাটা পড়েনি। কিংবদন্তি এই শিল্পী এখন কেমন আছেন। গান নিয়ে তাঁর বলা কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
কেমন আছেন?
শরীরটা এখন খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। করোনা হওয়ার পর তা থেকে সেরে ওঠলেও এর নানা উপসর্গ আমাকে খুব ভোগাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে গান নিয়ে ব্যস্ততায় সময় কাটাতে চাই। সবাই দোয়া করবেন যাতে আমি শিগগিরই সুস্থ হয়ে ওঠতে পারি। আবার যেন আমার প্রিয় গানের ভুবনে নিয়মিত ফিরতে পারি।
গান দিয়ে দেশীয় সংগীত ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, আগামীতে কী উপহার দেবেন?
আমি তো তরুণ শিল্পীদের নিয়ে টিভিতে গানের এ আয়োজন করেছিলাম। এখন ভাবছি নতুনদের নিয়ে আর কি করা যায়। আমার সৃষ্টির নেশা আজও একবিন্দু কমেনি। পরিকল্পনাও তাই থেমে নেই। আরও নতুন কী আয়োজন করা যায়- তা নিয়ে সবসময় ভাবী। ‘গানে গানে দেশে দেশে’-এর মতো আমার করা অনুষ্ঠানের চেয়ে সমৃদ্ধ আরও নানা ধরনের আয়োজন হতে পারে। যখন বিটিভিতে ছিলাম, তখনো নতুন কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবতাম। চেষ্টাও করেছি কয়েকটি ভিন্ন ধাঁচের অনুষ্ঠান করার। অনেকে এ-ও বলেছেন ‘গানে গানে দেশে দেশে’ অনুষ্ঠানের আগে এ ধরনের আয়োজন তাদের চোখে পড়েনি। এই যে দর্শকের মত, তা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন কিছু হয়ে উঠেছে। তাই বলে একই আয়োজনের বাইরে আর কিছু করা যাবে না, তা নয়। ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আরও হতে পারে, এটা কেবল কথায় নয়, সময়-সুযোগ পেলে করেও দেখাতে চাই। যদিও অনেকে বয়সের দোহাই দিয়ে নতুন কিছু করার বিষয়ে পিছিয়ে আসেন। কিন্তু আমি সে দলের নই।
সংগীত জীবনের এ পর্যায়ে এসে নিজেকে কতটা তৃপ্ত মনে হয়?
তৃপ্ত বলাটা খুবই মুশকিল। আমি মনে করি, কোনো শিল্পীই তৃপ্ত হয় না। কারণ তৃপ্তি হয়ে গেলে তো সবই শেষ হয়ে গেল। বরং উল্টো করেই বলি, আমার তেমন অতৃপ্তি নেই। আমার কাছে সবচেয়ে বড় হলো মানুষের ভালোবাসা।
আগে দেশের গান জনপ্রিয় হতো। কিন্তু এখন তেমন হচ্ছে না, কেন?
দেশের গান হলো আবেগের ব্যাপার। সেই গানগুলো হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সময় বা কিছু পরের। তখন মানুষের মনে, শিল্পীদের মনে আবেগ ছিল। স্বাধীনতার পর তখন শ্রোতাদের মনও সেসব গান গ্রহণ করার জন্য তৈরি ছিল। এখন সেই সময়টা থেকে দূরে চলে এসেছি।
এক জীবনে অনেক গান করেছেন এই সংখ্যাটা কেমন?
গানের কোনো হিসাব রাখিনি। তাই আমার কাছে কেউ জানতে চাইলে বলি এই সংখ্যা পাঁচ শও হতে পারে আবার ৫ হাজারও হতে পারে।
রিয়েলিটি শোর শিল্পীরা বেশি দিন টিকতে পারছে না। এর কারণ কী?
যে দু-একজন শিখে এসেছে, তারা টিকে গেছে। অথবা যারা টিকে যাওয়ার পর শিখেছে তারা শেষ পর্যন্ত টিকে থেকেছে। কিন্তু, যারা হঠাৎ করে তারকা হয়ে গেছে, তাদের তারকা হওয়ার যে তৃপ্তি তা পূরণ হয়ে যাওয়ার ফলে তারা টেকেনি। যারা তাড়াতাড়ি এসেছে, তারা তাড়াতাড়ি চলে গেছে।
পছন্দের এমন কোনো শিল্পী আছে কী, যার সঙ্গে গান করার ইচ্ছা রয়েছে আপনার?
আমার একটা ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেটা পূরণ হওয়া এখন আর সম্ভব নয়। কারণ তিনি জীবনের ওপারে চলে গেছেন। তিনি হলেন সলিল চৌধুরী। তাঁর সুরে আমার একটি গান করার খুব ইচ্ছা ছিল।
মূল শিল্পী, গীতিকার ও সুরকারের নাম না নেওয়া বিতর্ক চলমান? কী বলবেন?
এটা অন্যায়। এটা স্রেফ অন্যায়। অবশ্যই অন্যায়। নাম তো অবশ্যই থাকবে। নাম না থাকা তো অপরাধ। গানটি কে অরিজিনালি গেয়েছেন তার মূল শিল্পী কে, এটা বলতে হবে এবং সম্মানের সঙ্গে বলতে হবে। এ বিষয়টি আমিই প্রথম শুরু করেছিলাম। তখন থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গীতিকার, সুরকার এবং মূল শিল্পীর নামটা বলা হয়। ইট ইজ অ্যা মাস্ট গীতিকার, সুরকার এবং মূল শিল্পীর নাম বলতে হবে।
দেশের কপিরাইট আইন নিয়ে অনেক অভিযোগ, আপনার মতামত কী?
এ নিয়ে আর নতুন করে কী বলব। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমরা হয়েছি। এখনকার শিল্পীরা তো যার যার গান কপিরাইট করে নিচ্ছে। কিন্তু আমরা আমাদের গানের রয়্যালিটি পেলাম না।
ডিজিটাল প্ল্যাটফরম মূল শিল্পীর গান কাভার সং প্রকাশ নিয়ে কিছু বলুন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারমিশন নেওয়া হয় না। তবে তোমরা পারমিশন নাও আর নাই নাও; এটাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে যিনি আগে গেয়েছেন তাদের নামটা বলতে হবে। কারণ গানটা যে পরিচিত করিয়েছেন, জনপ্রিয় করিয়েছেন তারাই।
এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ, গানের জগতে আসার গল্পটা কেমন?
আমার বাবা গান গাইতেন এবং কলেরগানে গান শুনতে পছন্দ করতেন। বাবার শখের গ্রামোফোন রেকর্ডের গান শুনে কৈশোরে সংগীত অনুরাগী হয়ে ওঠি। তখন থেকেই গাইতে গাইতে গান শিখেছি। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাইছি। ১৯৬০ সালে ছাত্রজীবন থেকেই চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু। ১৯৬৪ সালে একক কণ্ঠে প্রথম বাংলা সিনেমায় গান করি। ছবির নাম ছিল ‘ডাকবাবু’। মো. মনিরুজ্জামানের রচনায় সংগীত পরিচালক আলী হোসেনের সুরে এ গানের মাধ্যমে আমার চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের যাত্রা শুরু। বেতারে গাওয়া প্রথম জনপ্রিয় গান ‘কিছু বল, এই নির্জন প্রহরের কণাগুলো হৃদয় মাধুরী দিয়ে ভরে তোল’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশ হয় আমার প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের একক অ্যালবাম ‘যখন ভাঙল মিলন মেলা’। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে অনার্স পড়ার সময় সুবল দাস, পি সি গোমেজ, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ প্রমুখ গান শেখার ক্ষেত্রে আমাকে সহায়তা দেন ও উৎসাহ জোগান।
প্লেব্যাক কৌশল কীভাবে আয়ত্তে এনেছিলেন?
একজন শিল্পী প্রতিনিয়তই শেখে। এক্ষেত্রে নিজের মেধাকে প্রয়োগ করতে হয়, কোনটা নিতে হবে আর কোনটা বাদ দিতে হবে, তা জানা দরকার। বড় পর্দায় গান করলে কণ্ঠস্বর চরিত্রের সঙ্গে মেলাতে হবে। যার কণ্ঠে গান, চলচ্চিত্রে তার যে চরিত্র বা অবস্থান তাও শিল্পীকে বুঝতে হয়।
ছোটবেলা থেকেই কী গায়ক হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
না, হতে চেয়েছিলাম শিক্ষক, কিন্তু ভাগ্যের কালচক্রে হয়েছি গায়ক। ছোটবেলা থেকেই ছিলাম বাউ-ুলে ধরনের, স্কুলের পর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাই ছিল আমার প্রধান কাজ। কলেরগান শুনেই সংগীতের প্রতি জাগে অগাধ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা থেকেই ধীরে ধীরে গানের জগতে প্রবেশ। গানের টানে শিক্ষক আর হওয়া হলো না আমার।
সময়ের সঙ্গে শ্রোতার চাহিদা বদলে যায়। এ বিষয়ে কী বলবেন?
অস্বীকার করছি না যে, সময়ের সঙ্গে শ্রোতার চাহিদা বদলে যায়। এ জন্যই শিল্পী থেকে শুরু করে গীতিকার, সুরকার, সংগীতায়োজক- সবাই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। এ চেষ্টা থেকেই তো বিবর্তন। আমরাও চেষ্টা গানের কথা, সুর, সংগীত এবং গায়কিতে সময়কে ধরে রাখার। একটা বিষয় সবসময় মাথায় রেখেছি, তা হলো গানে মেলোডি ধরে রাখা। কারণ মেলোডি সুরের গানের চাহিদা আজও ম্লান হয়নি।
শিল্পী হিসেবে আপনি কতটা পরিপূর্ণ?
একজন শিল্পীর জীবনে কিছু না কিছু অপূর্ণতা থেকেই যায়। কেউ তা থেকে মুক্ত নয়। কেউ বলতে পারবে না পৃথিবীতে আমার জীবন পরিপূর্ণ। সে অর্থে আমারও কিছু অপূর্ণতা রয়েছে। মনে হয়, আরও ভালো করতে পারতাম। কিন্তু সেই সময় পাব কি না জানি না।