প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ। সমাজ, দেশ ও পরিবারের নানা অবক্ষয়ের চিত্র সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে ধরে তিনি হয়ে গেছেন কালজয়ী। বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের মানুষের কর্ম নিয়ে তাঁর চিন্তা-চেতনার কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট চলচ্চিত্রের নতুন গতিপথের সঙ্গে দর্শক একাত্ম হয়েছে। এতে আপনার অনুভূতি কেমন?
হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদের ঝিমিয়ে পড়া চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য এটি একটি সুখের কথা। আমার মতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মতো সব সময় সবকিছুর নতুন গতি সৃষ্টি হয়। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এখন একঝাঁক নতুন ছেলে গল্প বলার ধরন, নির্মাণ, প্রযুক্তি, উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন ট্রেন্ডের সূচনা করেছে। এখনকার নতুন দর্শকরা কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই নতুন পথে হাঁটতে চায়, নতুন কিছু দেখতে চায়। তাই চলচ্চিত্রের এই নতুনত্বে তারা তাদের স্বপ্নের মিল খুঁজে পেয়েছে। ফলে সপরিবারে আবার দর্শকের উপস্থিতি শুরু হয়েছে সিনেমা হলে। মানে নতুনের জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। এটি আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। যেসব নতুন ছেলের হাতে দেশীয় চলচ্চিত্র আবার নতুন করে জীবন পেয়েছে তাদের শুভকামনা জানিয়ে বলব এই শুভদিনকে তোমরা হারিয়ে যেতে দিও না।
চলচ্চিত্রের কিছু মানুষের ব্যক্তিগত কাজ দর্শকদের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি করছে, এ বিষয়ে কি বলবেন?
আমাদের চলচ্চিত্রের নানা অবক্ষয় কিন্তু শিল্পটিকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন আবার যখন সুদিন ফিরতে শুরু করেছে তখন সবার লক্ষ্য রাখা উচিত ব্যক্তিগত বা পেশাদারি কাজ এমন হওয়া দরকার যাতে কোনো নেতিবাচক কর্মের কারণে দর্শক আবার আমাদের চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়। গোপনে প্রেম, বিয়ে বা সন্তান নেওয়া অপরাধের বিষয় নয়। এটি একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। একজন সুপারস্টার মনে করতেই পারেন যে, প্রেম, বিয়ে, সন্তানের কারণে তার ক্যারিয়ার বা স্টারডাম ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। তাই সে চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থে তা গোপন রাখতেই পারে। অতীতেও অনেক বিবাহিত শিল্পী এই অঙ্গনে এসে শিল্প ও নিজের ফিল্মি ক্যারিয়ার যাতে ক্ষতি না হয় সে জন্য সবকিছু গোপন রাখতেন। সম্প্রতি জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খান বিয়ে, সন্তান নিয়ে যা করেছে সে বিষয়ে আমি যারা এটি নিয়ে নেগেটিভ কথা বলছে তাদের প্রশ্ন করছি তাহলে কী সংবাদ সম্মেলন করে শাকিব খানের বলা উচিত ছিল যে, আমি প্রেম করছি, বিয়ে করছি, আমার সন্তান হয়েছে। আরে এটা কেমন কথা, শিল্পীদেরও তো ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু আছে। চলচ্চিত্রকারদের নিজের জীবন নিয়ে, নিজেদের মতো করে লাইফ লিড করার মতো অধিকার কী নেই।
এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব নিয়ে তো চর্চা বেশি হয়, এটি কীভাবে দেখছেন?
এটি অনৈতিক চর্চা। আমি বলব, প্রকৃত গণমাধ্যম বা সত্যিকারের সাংবাদিকরা এসব বিষয় নিয়ে কখনো নোংরামি করে না। আজকাল ইউটিউবার নামে যে যন্ত্রণা বা কথিত সাংবাদিকতা তৈরি হয়েছে তারাই ভিউ বাড়ানো ও নিজেদের স্টার বানানোর জন্য সত্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়ে সুন্দর পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে পরিবেশ কলুষিত করছে। এটি একটি অনৈতিক ও গর্হিত কাজ। এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির মতো অপরাধ থেকে যাতে বিরত থাকে সে জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সরকারকে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার ব্যস্ততা এখন কেমন?
হ্যাঁ, ‘গ্রিনকার্ড’ চলচ্চিত্রের নির্মাণকাজ শেষ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে এ ছবির শুটিং হয়েছে। আমি ঢাকায় বসে ভার্চুয়ালি এর ডিরেকশন দিয়েছি। ‘জয় বাংলা’ ছবির কাজও শেষ করেছি। আগামী ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে ছবিটি মুক্তি পাবে। এখন দুটি ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। একটির নাম ‘ঘুম’ অন্যটি ‘হোসনা বানুর জবানবন্দী’। ছবি দুটি এক টিকিটে দর্শক ইন্টারভ্যালের আগে ও পরে একটি করে দেখতে পাবে। যেসব কিশোর ড্যান্ডি খেয়ে নেশা করে অকাল মৃত্যুর দিকে নিজেদের যেভাবে ঠেলে দিচ্ছে তার কুফল ও পরিত্রাণের বাণীকে ঘিরে ‘ঘুম’-এর গল্প গড়ে ওঠেছে। অন্যদিকে ইভ টিজিং ও ধর্ষণের শিকার একটি মেয়ের বঞ্চনাময় জীবন কাহিনি বর্ণিত হয়েছে ‘হোসনা বানুর জবানবন্দী’ ছবির গল্পে।
এক টিকিটে দুই ছবি কেন?
এখনকার দর্শকদের মধ্যে সিনেমা হলে বসে একটানা তিন ঘণ্টা একটি ছবি দেখার ধৈর্য ও সময় নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি এবং মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে। এখনকার দর্শক গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তাই তাদের সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনতে হলে নতুনত্ব দিয়ে তাদের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলেই চলচ্চিত্রের সুদিন অক্ষুণœ থাকবে।
চলচ্চিত্র নির্মাণের সূতিকাগারখ্যাত এফডিসিতে চলচ্চিত্রের কাজ কমে যাওয়ার কারণ কী?
এখন চলচ্চিত্র নির্মাণ বেড়েছে। কিন্তু এফডিসিতে বেশির ভাগ নির্মাতাই কাজ করতে চান না, এখানকার যন্ত্রপাতিও অনেকেই ভাড়া নিতে চান না। প্রাইভেট সেক্টরের দিকেই প্রায় সবাই ঝুঁকে পড়েছে। এর কারণ এফডিসির লোকেশন ও যন্ত্রপাতির ভাড়া অনেক বেশি। আয়ের অভাবে। এ কারণে এফডিসিতে কর্মরতদের বেতন-ভাতা ও অবসরের পর সহজে পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তাই এফডিসি কর্তৃপক্ষ ও সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ, নির্মাতাদের এফডিসিতে কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে যারা সম্পূর্ণ কাজ এফডিসিতে করবে তাদের যেন ৪০ থেকে ৫০ পার্সেন্ট ভাড়া রিবেট দেওয়া হয়।