নিবেদিতপ্রাণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর। বহুমুখী প্রতিভায় বিদগ্ধ এই গুণী নাট্যজন। একজন তুখোড় অভিনয়শিল্পীর পাশাপাশি নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন নির্দেশক, আবৃত্তিশিল্পী, সংগঠক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে। তার ভরাট গলার আবৃত্তি তন্দ্রাচ্ছন্ন করে রাখে শ্রোতাদের। এই শক্তিশালী অভিনেতার সাম্প্রতিক ব্যস্ততা ও সমসাময়িক কাজ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন - পান্থ আফজাল
শরীর কেমন আছে আপনার?
আছে, ভালোই তো। সব কাজ ঠিকঠাক মতো করতে পারছি।
৩১ অক্টোবরে ৭৬ বসন্তে পা দেবেন। ছোটবেলার জন্মদিন উদযাপন কীভাবে হতো?
আমাদের ছোটবেলায় জন্মদিন হতো না। যতটুকু মনে পড়ে, বাড়িতে একটু ভালো রান্নাবান্না হতো। কাউকে দাওয়াত করা বা ঘটা করে কিছু করা হতো না। আর আমি সর্বদা জন্মদিনের আয়োজন অ্যাভয়েড করে গেছি। ছিয়াত্তর বছর বেঁচে থাকাও তো একটা বিশাল ব্যাপার!
কিছুদিন আগে কবীর সুমনের গান শুনতে গিয়েছিলেন। সেদিন তার গাওয়া গান ও কথা শুনতে কেমন লেগেছে?
সবসময়ই ভালো লাগে। সেদিনও লেগেছিল। একসময় তো কবীর সুমনের গান বাংলাদেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছিল এবং এখনো তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি একদম ভিন্নভাবে খেয়াল গান নিয়ে কাজও করেছেন। সেদিনের সেই আয়োজনেও অনেক গানপ্রেমী শুধু সুমনকেই শুনতে এসেছিলেন। এটা ভাবতে ভালো লাগে যে, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের গানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। গানের কনসার্ট মানে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, যেখানে ৮০ শতাংশই এই প্রজন্মের।
অভিনয় কমিয়ে দেওয়ার কারণ কী?
আমরা যারা রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছি, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনটি তেমন নির্ঝঞ্ঝাট নয়। সে কারণেই হয়তো আমি অভিনয় অনেক কম করি বা করি না বললেই চলে। দীর্ঘদিন অভিনয় না করার ফলে, যেটা বলা হয় অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পায়। আমারও বিদ্যা হ্রাস পেয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘নিমফুল’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’ কিংবা ‘আজ রবিবার’-এর মতো দর্শক টিভি নাটকের নিয়মিত আপনাকে দেখতে চায়...
আমি নিয়মিত অভিনয় করতে চাই, তবে ভালো গল্পের স্ক্রিপ্ট হতে হবে। আমার কাছে অনেকেই স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসে; কিন্তু গল্প পছন্দ হয় না। গল্প ও নির্মাণ ভালো হলে করতে সমস্যা নেই। আগে প্রচুর একক নাটকেও অভিনয় করেছি। এখন অবশ্য ধারাবাহিকে অভিনয় করতে চাই না। একক হলে করব। ভালো গল্পের ওয়েব-সিরিজ হলেও করতে অসুবিধা নেই। ভালো গল্প ও নির্মাণ ভালো হলে চলচ্চিত্রও নিয়মিত করা যায়।
অনুদানের সিনেমা ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় অভিনয় করেছেন। চরিত্র ও গল্পটি কেমন? শুটিং শেষ?
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিখ্যাত উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ থেকে সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন। মানিকগঞ্জে সিনেমাটির শুটিং করা হয়। শুটিং শেষ। অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেছি; বড় ভাইয়ের চরিত্রে।
‘জয় বাংলার ধ্বনি’তে শম্ভু রাজাকারের চরিত্রে দেখা যাবে। এই নেতিবাচক চরিত্রটি কেন বেছে নিলেন?
বরাবরই আমার নেতিবাচক চরিত্রের প্রতি আগ্রহ ছিল। এর গল্প শুনে মনে হলো করা যায়। খুবই ইন্টারেস্টিং লাগল। তাই কাজটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া। অন্যদিকে এ ছবিতে আসার পেছনের গল্প মূলত শাজাহান ভাই। যিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা, তার আবেগ দিয়ে, অভিজ্ঞতা, দেশপ্রেম দিয়ে তিনি একটি ইতিহাসকে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন তার কাহিনির মধ্য দিয়ে। সে কারণে তার যে অনুরোধ, সেটা রাখাটা আমার জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। আগে যেমন নিয়মিত অভিনয় করতাম, সেই সময়কার দক্ষতা এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তবুও আমার সবটুকু চেষ্টা করব। ১ নভেম্বর থেকে আমার ডেট দেওয়া হয়েছে। শুটিং হবে ফরিদপুরে।
নিজেকে কিংবদন্তি পরিচয় দিতে আপত্তি করেছেন। কারণটি একটু খোলাসা করবেন?
আসলে এই শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হতে হতে খুব মলিন হয়ে গেছে। এটি ব্যবহার কম বা না করাই ভালো। আমার চোখে কিংবদন্তি শিল্পী বলতে যাদের বুঝি, যেমন গোলাম মোস্তাফা আছেন, আনোয়ার হোসেন আছেন কিংবদন্তি শিল্পী। আমরা ওই পর্যায়ের শিল্পী এখনো হতে পারিনি বলে আমি বিশ্বাস করি।
গ্যালিলিওসহ কিছু মঞ্চনাটকে দীর্ঘদিন পর মঞ্চে পাওয়া গিয়েছিল...
বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিলাম; এরপর মঞ্চেই কিছু কাজ করেছি। নিয়মিত মঞ্চে কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সেই পুরনো নাট্যকারের স্ক্রিপ্টই মঞ্চে বারবার আসছে। নতুন নাট্যকারের অভাব বোধ করেন কী?
সেটা ঠিক। এখন তো ভালো নাট্যকারের অভাব। এই অভাবটা একই সঙ্গে মঞ্চে এবং টিভিতে। নতুন নাট্যকার সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। তেমন করে তাদের ভালো নাটক পাচ্ছে না থিয়েটার দল। এক সময় আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজউদদীন আহমদের মতো দুর্দান্ত নাট্যকার ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ টেলিভিশনের জন্য দারুণ সব নাটক লিখতেন। তাদের লেখা নাটক টিভিতে ও মঞ্চে মঞ্চস্থ হতো। দর্শক মুগ্ধ হয়ে সংলাপ শুনতেন। মুখস্থও করে ফেলতেন সংলাপ।
এখন কী তাহলে ভালো নাটক হচ্ছে না?
হচ্ছে, তবে অনেক কম। তেমন করে তো ভালো নাটক হচ্ছে না। ভালো নির্মাতারও সংকট রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মতো নির্মাতার অভাব অনুভব করি।
সেই সময়ের টিভি নাটকের সঙ্গে এই সময়ের নাটকের পার্থক্য কী রয়েছে?
আমাদের সময় নাটক ছিল ভিন্ন স্বাদের। শুটিং শেষ করেছি সুন্দরভাবে। বিটিভিতে সন্ধ্যার পর সবাই মিলে নাটকের মহড়া করেছি; সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা তো চলতই। এখন তো সবাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে। নাটকে নেই কোনো অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন!
দীর্ঘদিনের কর্মস্থল দেশ টিভি ছাড়ার কারণ কী ছিল?
আসলে ওটা ব্যক্তিগত। আমাকে অনেক কিছুতে সময় দিতে হয়। অভিনয়, রাজনীতি, আবার ছোটখাটো ব্যবসাও আছে। এতসব করে নিজের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে যায়। তাই ছেড়েছি।