সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজ্জাকের শূন্যতা কখনো কাটবে না : ববিতা

জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা

রাজ্জাকের শূন্যতা কখনো কাটবে না : ববিতা

চলচ্চিত্রের যে কোনো উৎসবে মধ্যমণি হয়ে থাকেন একজনই। তিনি নায়করাজ রাজ্জাক। এমন উচ্চতায় যে রাজার আসন, মৃত্যু তাঁকে কখনো ছুঁতে পারে না।  এ দেশের চলচ্চিত্র জগতে নায়করাজের শূন্যতা কখন কাটবে তা কেউ জানে না। আজ তাঁর ৮১তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

নায়করাজ রাজ্জাক। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি। একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। কিশোর বয়সে কলকাতার মঞ্চনাটক দিয়ে অভিনয়ে যাত্রা শুরু তাঁর। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার উত্তাল সময় নতুন জীবন গড়তে সাধারণ মানুষ হিসেবে রাজ্জাক পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন প্রায় অসহায় অবস্থায়। কঠোর পরিশ্রম আর জীবনে প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে সংগ্রাম করে হয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সবার কাছে জনপ্রিয় হন তিনি। ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে সুচন্দার বিপরীতে নায়ক হিসেবে ঢালিউডে প্রথম উপস্থিত হন এবং সবার মন জয় করে নেন। দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে নায়করাজ উপাধি পান। ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। চারবার জাতীয় সম্মাননা লাভ করেন। তাঁর সফল কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্র তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’-এ ভূষিত করে। রাজ্জাক অসীম মনোবল, অমানুষিক পরিশ্রম আর মমতার মাধ্যমে নিজের লক্ষ্যে  পৌঁছেছেন। চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি হয়েছেন। নায়করাজের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতায়।  ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন দেশীয় চলচ্চিত্রের এই অবিসংবাদিত রাজা।

আমি ও রাজ্জাক ভাই ছিলাম সতীর্থ। জহির রায়হানের হাত ধরে দুজনে চলচ্চিত্রে এসেছি। ওই সময় আমি ছিলাম বেণি দোলানো কিশোরী। রাজ্জাক ভাই ছিলেন টগবগে যুবক। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সিনেমা ছিল ‘সংসার’। এতে তিনি ছিলেন আমার বাবা। এরপরই তাঁকে নিয়ে আমাকে নায়িকা করে ‘শেষ পর্যন্ত’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়। ওই সিনেমার বেশ কয়েকটি রোমান্টিক দৃশ্য ছিল। কদিন আগে আমি যাকে বাবা বললাম তাঁর [রাজ্জাক] সঙ্গে আবার রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয়! বুকে মুখ রেখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে- এটা ভেবে লজ্জায় আমার মুখ থেকে সংলাপ বের হয়নি। জহির রায়হান ভাই আমাকে খুব বকা দিয়ে বললেন- ‘তুমি কী মনে করেছ, এটা সত্যি নাকি? এটা তো অভিনয়।’ তাঁর সঙ্গে আমার অভিনয়ের দৃশ্যের ওই স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। ১৯৬৯ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। এটির সাফল্য ছিল আকাশছোঁয়া। আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের, ভাইবোনের মতো। তাই সম্পর্কটা পারিবারিকও। মাসখানেক দেখা না হলে একে অপরকে ফোন করে খবর নিতাম। রাজ্জাকের মৃত্যুর কয়েক দিন আগে রাজ্জাককে কল দিয়েছিলাম। আমি তাঁকে নিমন্ত্রণ করলাম। বললাম রাজ্জাক ভাই অনেক দিন দেখা হয় না। আমার বাসায়ও আপনি আসেন না অনেক দিন। ভাবিকে নিয়ে একবার আসেন। আপনাকে কিছু রান্না করে খাওয়াতে চাই। তিনি বললেন, থাইল্যান্ড যাবেন ঘুরতে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একটু বেড়াতে চাইছেন। সেখান থেকে এসে আমার বাসায় আসবেন। কাঁদতে কাঁদতে ববিতা বলেন, ‘সে ভাগ্য আমি আর পেলাম কই। তাঁকে অনেকবারই রান্না করে খাইয়েছি। কিন্তু শেষবার যখন আবদার করলাম, কথা দিয়েও আসলেন না তিনি। আমাদের অভিভাবক চলে গেলেন।’ আমি তাঁকে বলি দার্শনিক। জীবনের প্রতি তাঁর অগাধ মমতা ছিল। সময়কে তিনি কাজে লাগিয়েছেন সফলভাবে। তাঁর অবদান এ দেশের চলচ্চিত্র কোনো দিন ভুলতে পারবে না। রাজ্জাকের সঙ্গে ৪০টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছি। চলচ্চিত্র জগতের একটা পিলারের নাম ‘রাজ্জাক’। ‘আমি চাই প্রয়াত শিল্পী নায়করাজ রাজ্জাকের নামে একটি ইনস্টিটিউট হোক। কিংবা তাঁকে নিয়ে একটি ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করা হোক।’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের প্রথম সুপারস্টার, নায়ক রাজ্জাক আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পান। নায়করাজ হিসেবে পরিচিত আবদুর রাজ্জাক প্রায় তিন দশক বাংলাদেশের সিনেমায় নায়ক হিসেবে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে একটা শক্ত প্রভাববলয়  তৈরি করেছিলেন। ৭৫ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুতে একটা অধ্যায়ের প্রস্থান হওয়ার কথা অনেকে বলছেন। তাঁর চিরবিদায়ে বাংলাদেশের সিনেমা জগতে শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নায়ককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নেমেছিল। তাঁদের মধ্যে তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে ষাটের বেশি বয়সের নারী-পুরুষকে দেখা গিয়েছিল। তাঁদের অনেকে বলছেন, রাজ্জাক অভিনীত সিনেমা দেখলে তাঁরা যেন নিজের জীবনকে খুঁজে পেতেন। তাঁদের অনেকের মতে নায়করাজের চলে যাওয়ায় সিনেমা জগতে বড়ই শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তা পূরণ করা সম্ভব হবে কি না, এ নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের সিনেমার সাদা-কালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেন রাজ্জাক। একের পর এক সিনেমা করে তিনি নায়করাজ হিসেবে পরিচিতি পান। ৫০ বছর ধরে চলচ্চিত্র শিল্পে তিনি তিনশর বেশি ছবিতে অভিনয় করেন। নিজের চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন’ ও ‘রাজলক্ষ্মী টেলিফিল্ম’ থেকে দুই ডজনেরও বেশি দর্শকপ্রিয় ছবি নির্মাণ করে গেছেন এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার নায়করাজ রাজ্জাক। এককথায় বলব- রাজ্জাক ভাই আমাদের চলচ্চিত্র জগতের একজন প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তি। মানুষ হিসেবেও ছিলেন অমায়িক ও পরোপকারী। নায়করাজের ব্যক্তিত্ব অনুসরণীয়। অভিভাবক হিসেবে সবাইকে তিনি ছায়া দিতেন। ভালো বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। তাঁর সন্তানদের সুন্দর করে মানুষ করেছেন। একজন আদর্শ পিতা, স্বামী হিসেবে ছিলেন সার্থক। ছিলেন আদর্শ মানুষ। তাঁর মতো মহানায়ক এ দেশে আসেনি। আর আসবে বলে মনেও হয় না।  আমরা যেন তাঁকে ভুলে না যাই। এ প্রজন্মের শিল্পীরা যেন তাঁকে মনে রাখে, শ্রদ্ধা করে। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ যেন অনুসরণ করে।

সর্বশেষ খবর