শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

সুচিত্রা সেনের অন্তর্ধানের সেই গল্প...

সুচিত্রা সেনের অন্তর্ধানের সেই গল্প...

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। ১৯৫২ সালে রুপালি পর্দায় এলেন, জয় করলেন, এই বিজয়ের ধারা ২৬ বছর গড়িয়ে ১৯৭৮ সালে এসে থামল। ওই বছরই মহানায়িকা নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে নিলেন। কিন্তু কেন এই অন্তর্ধান- সেই রহস্য তুলে ধরেছেন আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যে কারণে অন্তর্ধান...

‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো...’ সত্যি, সুচিত্রা সেনের পথ শেষ হয়নি, নশ্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেলেও বিশ্বজুড়ে কোটি দর্শক-ভক্তের হৃদয়ে এখনো অবিনশ্বর হয়ে আছেন তিনি। সেই ভুবন মোহিনী হাসি, মায়াভরা চেহারা আর অভিনয় দক্ষতা এখনো আবাল বৃদ্ধ-বণিতার ঘুম হরণ করে। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ দিয়ে সেলুলয়েডের রুপালি জগতে তার পদচারণা শুরু। যাত্রার সমাপ্তি ১৯৭৮ সালে। ওই বছর ভুবনমোহিনী এই অভিনেত্রী নিজেকে জগৎসংসার থেকে আড়াল করে নিলেন। চলে গেলেন অন্তর্ধানে। কিন্তু কেন? যার বসবাস ছিল কোটি কোটি দর্শক হৃদয়ে, যে কিনা ২৬ বছরের অভিনয় জীবনে উপহার দিয়েছেন ৫২টি বাংলা ও সাতটি হিন্দি চলচ্চিত্র। তিনি কী এমন আত্ম অভিমানে নিজেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে নিয়ে গেলেন। এ বিষয়ে মহানায়িকা কখনো মুখ না খুললেও তাকে নিয়ে যারা গবেষণায় ব্রত ছিলেন তাদের মধ্যে লেখক-সাংবাদিক শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়- মহানায়িকা সুচিত্রা সেন সাধনাতেই ব্রত ছিলেন। সাধনার কারণে অন্তর্ধানে চলে যাওয়ায় সে সময়ে তাকে কম ব্যঙ্গ, কটুকথা, অপমানজনক মন্তব্য শুনতে হয়নি। কেউ বলেছে নিজের বাজার পড়ে যাচ্ছে জেনে নির্বাসন, কেউ বলেছে শ্বেতী হয়ে গেছে, কেউ আবার রটিয়েছে ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে তার, তাই স্বেচ্ছা নির্বাসন। কেউবা বলেছে বিগতযৌবনা নায়িকা হয়ে গেলে সরে যেতেই হয়। কিন্তু এসব কোনো কিছুই টলাতে পারেনি সুচিত্রার সাধনা। তিনি নিজের চিত্তে অবিচল থেকেছেন। সুচিত্রা শুধু নিজেকে ঘরে অন্তরাল করেননি, বাইরের জগতের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সংশ্রবও ত্যাগ করেছিলেন। তার নির্বাসন ব্রতর প্রথম শর্ত লোভ, মোহ ত্যাগ করা, নিজেকে ইহজগতের মোহ থেকে মুক্ত করার দীক্ষামন্ত্র সুচিত্রাকে দিয়েছিলেন ভরত মহারাজ। শোনা যায়, ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবি ফ্লপ করার পর সুচিত্রা ছুটে গিয়েছিলেন ভরত মহারাজের কাছে। ‘প্রণয় পাশা’র গল্পটা ভালো ছিল, কিন্তু ছবিটা চলল না বলে ভেঙে পড়েছিলেন সুচিত্রা।

ছুটে যান বেলুড় মঠের গুরু ভরত মহারাজের কাছে। ভরত মহারাজ বলে দেন, ‘মা, লোভ কর না’। ওই মন্ত্রই যেন সুচিত্রা নিজের শেষ জীবন অবধি চলার পথে পাথেয় করে নেন। সমস্ত লোভ ত্যাগ করার জন্য ঘরে বন্দী করে ফেলেন নিজেকে। এ ঘটনার দুই বছর পর ১৯৮০ সালে সাংবাদিকদের ক্যামেরার চোখ এড়িয়ে মধ্যরাতে মহানায়ক উত্তম কুমারের বাড়িতে একবারই গিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। উত্তমকুমারের নিথর দেহে মালা পরাতে। সে বছরের বইমেলায়ও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সুচিত্রা সেনের আসার খবর বইমেলায় রটে যাওয়ায় আর থাকেননি। এরপর ১৯৮২ সালে তাঁকে দেখা যায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে। রবীন্দ্রসদনে গোষ্ঠ কুমারের মেকআপে এসেছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু আর নয়। এর পর দক্ষিণেশ্বর বা বেলুড়ে মাঝেমধ্যে গেলেও, তার বাইরে পুরোপুরিভাবে নিজেকে গৃহবন্দি করে ফেলেন তিনি। সেখানে যাওয়ার সময়ে দুই নাতনি নয়না (রাইমা) ও হিয়া (রিয়া) সঙ্গে থাকত। মহানায়িকা নিজেকে মুড়ে রাখতেন বোরকায়, কোনোভাবেই যেন তাঁকে দেখা না যায়। নিজের মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখতেন সর্বদা। অন্তরাল হওয়ার বুদ্ধি সুচিত্রাকে দেন কানন দেবীও। শেখান, বাজে ছবি করে যেন অর্জিত সুনাম না নষ্ট করেন সুচিত্রা। এ সময়ে যখন নির্বাচন কমিশন ভোটার কার্ডে ছবি তোলা বাধ্যতামূলক করল, সুচিত্রা সেনও গেলেন ছবি তুলতে। সে খবরও আগের রাতে রটে গেল খবরের কাগজের অফিসগুলোয়। কিন্তু ফ্রেমবন্দি করা সম্ভব হয়নি তাঁকে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের সামনের রাস্তায় ভিড় জমাই সার হয়েছিল। তবে ভোট দিতে যাওয়ার সময় সমস্যা হয়। ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজেই সেন পরিবারের ভোট দেওয়ার বুথ। বিভিন্ন কাগজের সাংবাদিক আগের দিন রাত থেকে সেখানে ঘাঁটি গেড়ে লুকিয়ে থাকলেন। কেউ আবার ছদ্মবেশে থাকলেন গোপনচারিণীকে ফ্রেমবন্দি করতে। সুচিত্রা তার চেনা প্রিমিয়ার পদ্মিনী গাড়ি থেকে নামতেই শাটার পড়ল কয়েক হাজার। সাদা চিকনের চুড়িদার পরে সুচিত্রা ধরা পড়ে গেলেন দুই দশক পরে। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় তিনি। এলো চুল, চোখে চশমা, চিকনের সাদা চুড়িদার হাত গোটানো কী অসম্ভব স্মার্ট সেই ৬৫ পেরুনো তরুণী। যেন একেবারেই সিনেম্যাটিক ব্যাপার। একটা সিনেমার প্লট। ২০০৫ সালে তাঁকে ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ দেওয়ার কথা উঠলেও তিনি ওই পুরস্কার গ্রহণ করতে চাকচিক্যের দুনিয়ায় পা ফেলতে চাননি। তিনি পুরস্কারটি ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন এবং স্পষ্টতই পুরস্কারটি তিনি আর পাননি। না কোনো অবসাদ, না কোনো রোগ, না কোনো বিকার। কেবল অবসর। সুচিত্রা নিজের সেরা সময়টা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।

 

বন্দি জীবনে যা করতেন...

সুচিত্রা সেন যে সারা দিন পুজো করতেন ঠাকুরঘরে, এটা একটা মিথ। এমনটা মোটেই নয়, এ কথা বলেছেন তার কন্যা মুনমুন সেনই। সুচিত্রার নিজের শোবার ঘরের পাশেই ছিল ঠাকুরঘর। স্নান সেরে পুজোয় বসতেন তিনি।

তার মানে এই নয়, সারা দিন ঠাকুরঘরে পড়ে থাকতেন। বরং সুচিত্রার সময় কাটত ধর্মপুস্তক পড়ে। রীতিমতো ধর্মীয় সাহিত্য নিয়ে চর্চা করতেন। তার বাড়িতে আসতেন বেলুড় মঠের মহারাজরাও। চলত আধ্যাত্মিক আলোচনা। একবার দক্ষিণেশ্বরে ভিড়ের মধ্যেই ঘোমটা দিয়ে ভবতারিণী দর্শনে মন্দিরে চলে গিয়েছিলেন। প্রণাম করেন হাঁটু গেড়ে। রামকৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে একমনে ধ্যান করতেন, তার পর ভরত মহারাজের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসতেন।

ভরত মহারাজ মারা গেলেন যখন সাদা ঢাকাইতে ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে, সানগ্লাস পরে, মেয়ে মুনমুনকে নিয়ে সুচিত্রা নিজে গিয়েছিলেন, শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

সর্বশেষ খবর