শিরোনাম
শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ববিতা যেভাবে চলচ্চিত্রে

ববিতা যেভাবে চলচ্চিত্রে

‘ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না, লাজে মরি মরি...’ প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এহতেশাম সত্তরের দশকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতাকে নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘বন্দিনী’ ছবিটি। আর এই ছবিতেই তিনি গানে গানে তাকে না ডাকার কথা বললেও এখনো দর্শক মনে গেঁথে আছেন ববিতা। প্রায় ছয় দশকের অভিনয় জীবনে এতটুকু ফিকে হননি তিনি। ববিতাকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যেভাবে অভিনয়ে

পুরো নাম ফরিদা আক্তার। ডাক নাম পপি। জন্ম ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই বাগেরহাটে। পৈতৃক বাড়ি যশোরে। ১৯৬৮ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ভগ্নিপতি এবং চিত্রপরিচালক জহির রায়হানের হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসেন। সেই বছর সিনে ওয়ার্কশপের ব্যানারে নির্মিত ‘সংসার’ ছবির মাধ্যমে প্রথমে রুপালি পর্দায় পা রাখেন। এ ছবিতে তিনি নায়ক রাজ্জাক ও নায়িকা সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন, যেখানে টাইটেলে তার নাম ছিল সুবর্ণা। জহির রায়হানের ‘জ্বলতে সুরুজ কি নিচে’ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই তার নাম ‘ববিতা’ হয়ে যায়। আর নায়িকা হিসেবে তার উত্থান ঘটে ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর দুই-তিনটি ছবি মুক্তি পেতেই নজরে পড়েন সত্যজিৎ রায়ের। সত্যজিতের ছবি ‘অশনি সংকেত’-এর ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রটি রূপায়ণ করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পান। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৭৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। গ্রামীণ কিশোরী বধূ কিংবা শহুরে আধুনিক মেয়ের চরিত্রে বেশ সাবলীলভাবে অভিনয় করেছেন ববিতা। তার সময়ে তরুণীদের কাছে ফ্যাশনের অপর নাম ছিল ববিতা। ভারতের সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অশনি সংকেত’ ববিতার অভিনয় জীবনের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রে তিনি ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রে অভিনয় ব্যাপক সাড়া ফেলে দেন। ২০১৫ সালে পুত্র এখন পয়সাওয়ালা ছবির পর চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, মানসম্মত গল্প আর চরিত্র না পেলে আর অভিনয় করবেন না তিনি।

 

ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবেন

জন্ম বাগেরহাটে হলেও তার শৈশব এবং কৈশোরের কিছু অংশ কেটেছে যশোরে। ববিতার মা ডাক্তার ছিলেন। বড় বোন সুচন্দা, ছোট বোন চম্পা এবং ভগ্নিপতি প্রয়াত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। ছোটবেলায় ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বড় বোন সুচন্দার হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসেন। একমাত্র ছেলে অনীক কানাডায় পড়াশোনা করেন।

 

যত সম্মাননা

ববিতা হলেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সোনালি সময়ের সবচেয়ে আধুনিক ও ফ্যাশন সচেতন মেধাবী অভিনেত্রী। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সর্বপ্রথম পুরস্কার লাভ করার গৌরব অর্জন করেন ১৯৭৫ সালে ববিতা। শুধু প্রথমবারই পুরস্কার পাওয়া নয়, এরপর টানা আরও দুবার মানে একটানা তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করে হ্যাটট্রিক করেছিলেন অভিনেত্রী ববিতা। বাঁদী থেকে বেগম (১৯৭৫), নয়নমণি (১৯৭৬), বসুন্ধরা (১৯৭৭), রামের সুমতি (১৯৮৫) এবং পোকামাকড়ের ঘরবসতি (১৯৯৬) চলচ্চিত্রগুলোর জন্য মোট পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ববিতা। প্রযোজক হিসেবেও জাতীয় পুরস্কার পান। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে সুঅভিনয়ের জন্য ববিতা ১৯৭৩ সালে ভারতে বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি থেকে চারবার, নন্দিনী চলচ্চিত্রের জন্য পাকিস্তানের জাতীয় চলচ্চিত্র পদক এবং ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমালোচক পুরস্কার অর্জন করেন ববিতা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৬তে আজীবন সম্মাননা পান ববিতা।

 

সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা

ববিতার ক্যারিয়ারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি চলচ্চিত্রের নাম ‘অশনি সংকেত’। ভারতীয় ক্যামেরাম্যান নিমাই ঘোষ স্বাধীনতার পর ঢাকায় এফডিসিতে এসে তার প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ছবি তুলে নিয়ে যান। সত্যজিৎ রায়ই তাকে ছবি তুলতে পাঠিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর ববিতার পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসায় ভারতীয় হাইকমিশন থেকে চিঠি আসে প্রাথমিক মনোনয়নের কথা জানিয়ে। সুচন্দা ও ববিতা তখন ভারতে যান সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সত্যজিৎ তাকে দেখে অনেক লাজুক ভেবেছিলেন। তাই ইন্দ্রপুরের স্টুডিওতে আবার তাকে পরীক্ষা করেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সত্যজিৎ বলেন, ‘আই অ্যাম সো হ্যাপি, আমি অনঙ্গ বউকে পেয়ে গেছি। ১৯৭৪ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ মুক্তি পেয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হলে এই ছবির অনঙ্গ বউ চরিত্রে রূপদানকারী ববিতা হয়ে যান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী।

 

আমজাদ হোসেনের ভূমিকা

ববিতার ক্যারিয়ারে আমজাদ হোসেনের নির্মিত নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, কসাই, জন্ম থেকে জ্বলছি ছবিগুলো চিরকাল বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের মাস্টার পিস চলচ্চিত্র হয়ে থাকবে। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রটি ছিল ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় চলচ্চিত্রের সর্বাধিক শাখায় রেকর্ড পুরস্কার পাওয়া একটি চলচ্চিত্র।

 

সামাজিক কর্মকাণ্ড

ববিতা ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ডিসট্রেস চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনালের (ডিসিআইআই) শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছেন। সংগঠনটি উন্নয়নশীল দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনা, চিকিৎসা এবং ভবিষ্যৎ গড়ার ব্যাপারে কাজ করে চলেছে। এ ছাড়া আরও অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন ববিতা।

 

ববিতার সুঃখ-দুঃখ

১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্টে প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা ‘শেষ পর্যন্ত’ সিনেমাটি মুক্তির দিনেই মারা যান ববিতার মা। ক্যারিয়ার শুরুতে ভগ্নিপতি জহির রায়হান তাকে সাহায্য করেছেন বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে। অভিনয়গুণে ৭০-এর দশকের পুরোটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ববিতা।

 

সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে স্মৃতি

জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অশনি সংকেত সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন ববিতা।

সিনেমার একটি স্মৃতি তিনি জানিয়েছেন এভাবে, ‘আমি স্পঞ্জের স্যান্ডেল খুলে লাফ দিয়ে পার হয়ে গেছি। পার হয়ে এপারে চলে এসেছি; কিন্তু স্যান্ডেলটা ওপারেই রয়ে গেছে। এখন অবস্থা এ রকম, স্যান্ডেল আনার জন্য আবার ওপারে যেতে হবে লাফ দিয়ে- এ রকম একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছি। তখন দেখলাম, মানিকদা এই ব্যাপারটা খেয়াল করলেন।

খেয়াল করে তিনি নিজে এগিয়ে এসে ওই পারে গিয়ে আমার স্যান্ডেল দুটো তুলে নিয়ে আবার এপারে এলেন। তারপর আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘নে’।’ সত্যজিতের এমন কাণ্ড দেখে একদম হা হয়ে গিয়েছিলেন ববিতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর