রবিবার, ১১ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

অঞ্জু ঘোষের দেশ ছাড়ার গল্প

অঞ্জু ঘোষের দেশ ছাড়ার গল্প

অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষের দিনকাল কেমন কাটছে। সম্প্রতি কলকাতায় নিজ বাসায় বসে এপার বাংলার কয়েকজন সাংবাদিককে জানালেন সেই কথা। অঞ্জু বললেন, খুব ভালো আছি। সেই যে মাধ্যমিক শেষ করে সিনেমায় নাম লিখালাম, তারপর টানা ষোলোটি বছর দিনরাত শুধু শুটিং আর শুটিং। আজ ঢাকা তো কাল কক্সবাজার, তো পরশু থাইল্যান্ড ছুটে চলা। বর্তমানে তিনি অনেকটা নিভৃতচারিণী হিসেবে পার করছেন দিনকাল। অঞ্জু ঘোষের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যে কারণে দেশ ছাড়লেন...

চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকাকালীনই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন অঞ্জু ঘোষ। কেন তিনি দেশ ছাড়লেন? এমন প্রশ্নে তাঁর অভিনয় জীবনের অন্যতম গুরু প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক সাইদুর রহমান সাইদ জানান, অঞ্জুর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকেই তাঁর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। এক চিত্রনায়কের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের প্রেম ছিল। সেই নায়ক হঠাৎ অন্যত্র বিয়ে করলে হতাশ হয়ে পড়েন অঞ্জু। ক্ষোভের বশে বিয়ে করেন চিত্রপরিচালক এফ কবির চৌধুরীকে। সেই বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। তাছাড়া কতিপয় মাস্তান তাঁর পিছু নেয়। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে কলকাতায় পাড়ি জমান অঞ্জু। তবে তিনি বলেন, ‘ওই সময় যে ধরনের অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব আসছিল তা আমার কাছে ভালো লাগেনি। সাজ-পোশাক সবকিছুতে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। তাই সিনেমা করা ছেড়ে দিলাম।’ তাঁর কথায় দেশের কথা সবসময়ই মনে পড়ে। চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে তাঁর কাছে মধুর মনে হয়। কারণ ওই শহরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সেখান থেকেই অভিনয় যাত্রা শুরু অঞ্জুর। এ অভিনেত্রী বলেন, ‘এমনও সময় গেছে ঢাকায় আমার বাড়ির দরজায় সারা রাত অপেক্ষা করেছে আমাকে দেখবে বলে। প্রেমিকদের দীর্ঘ নামের সারি। তাদের নাম আজ আর নাই বা বললাম। সবাই এখন সংসার করছে। চাই না তারা কেউ বিব্রত হোক।’ চিত্রপরিচালক এফ কবির চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে প্রসঙ্গে অঞ্জু বলেন, আমাদের কোনো দিনই বিয়ে হয়নি। আমার প্রোডাকশন থেকে প্রথম একটি সিনেমা নির্মাণ করি। প্রচুর অর্থ লগ্নি করি। কিন্তু ছবিটি যখন রিলিজ দেব তখন এফ কবির আবদার করে বসলেন, এই সিনেমাটি তাঁর ড্রিমল্যান্ড প্রোডাকশন থেকে রিলিজ করতে হবে। আমি বেঁকে বসলাম। দুজনের মধ্যে লেগে গেল দ্বন্দ্ব। অদ্ভুত বিষয় হলো চুক্তিপত্রে আমি যে স্বাক্ষর করেছিলাম তা জাল করে বিয়ের কাবিননামা বানানো হয়েছিল। এটা সত্যি যে, এফ কবির আমার শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন। অঞ্জু বলেন, আমার চারপাশে ওই সময় এত প্রেমিক ঘুরঘুর করত যে, আমি পাত্তা দিতাম না। এই অর্থে দিতাম না যে, মনে হতো সবাই আমার অর্থের মোহে আমাকে চাইত। সত্যিকারের ভালোবাসার কাউকে পেলাম না। বাংলাদেশের একজন চিত্রনায়কের সঙ্গে আমার সত্যিকারের মন দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল কিন্তু একটা সময় সে আমাকে ধোঁকা দেয়। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। তারপর আর ওই পথে যাইনি।

 

বর্তমান দিনকাল

সম্প্রতি সাংবাদিকদের সামনে অকপটে তুলে ধরলেন কেমন কাটছে এই সময়ে তাঁর দিনকাল। অঞ্জু ঘোষ বলেন, ‘কবে যে রাত হচ্ছে আর দিন হচ্ছে টেরই পেতাম না। একসময়ের ব্যস্ততা, এখন অফুরন্ত অবসর।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমার বাড়িতে মন্দির রয়েছে, ধর্মকর্ম, পূজা-পার্বণ করেই সময় কেটে যায়। আমার বাসায় যেমন দুর্গার প্রতিমা রয়েছে তেমনি পবিত্র মক্কা শরিফ, খাজা বাবার ছবিও রয়েছে। মানবধর্মের চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই।’ অঞ্জু ঘোষ কলকাতার সল্টলেকে ফ্ল্যাট কিনেছেন অনেক আগেই। সেখানেই থাকেন তিনি। ঘরের কাজকর্ম নিজেই করতে পছন্দ করেন। টেলিভিশনে খবর দেখেন, তবে টিভি সিরিয়াল দেখা তিনি পছন্দ করেন না। অবসর সময়টা ভাগ করে নেন নিজের ভাইয়ের বাচ্চাদের সঙ্গে। দীর্ঘদিন পর ২০১৮ সালে তিনি ঢাকা আসেন এবং প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক সাইদুর রহমান সাইদ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘মধুর ক্যান্টিন’-এ অভিনয়ে চুক্তিবদ্ধ হন। ছবিটির নির্মাণকাজ পরে আর শুরু হয়নি।

 

গিনেস বুকে নাম

দুই বাংলার একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন অঞ্জু ঘোষ। অঞ্জু যে সিনেমায় থাকতেন সেই সিনেমার প্রযোজক অনেকটাই নিশ্চিত থাকতেন তাঁর ছবি ব্যবসাসফল হবে। তাঁর নাম গিনেস বুকে উঠে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমায় প্রাণবন্ত অভিনয়ের জন্য। সম্মানিত হয়েছেন তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে। অঞ্জু ঘোষ বলেন, কলকাতায় যখন বিদেশি ডেলিগেটরা আসেন তাঁদের যদি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখানো হয় তার পাশে আমার ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটিও দেখানো হয়। সত্যি এটা আমার বড় পাওয়া।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে

১৯৮২ সালে ফোক ফ্যান্টাসি এবং রোমান্টিক ছবির নামি নির্মাতা এফ কবির চৌধুরী যখন ‘সওদাগর’ ছবিটি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন ঠিক করলেন এতে নায়িকা হিসেবে নতুন মুখ উপহার দেবেন তিনি। এরই মধ্যে অনেক মেয়ে দেখা হয়ে গেছে তাঁর, কিন্তু মনে ধরল চট্টগ্রামে মঞ্চনাটকে অভিনয় করা শিল্পী অঞ্জু ঘোষকে। নির্মাতা এফ কবির চট্টগ্রামে গিয়ে বেশ কিছু আঞ্চলিক নাটক দেখেন এবং অঞ্জুর অভিনয়ে মুগ্ধ হন। ব্যস, ১৯৮২ সালে অঞ্জু ঘোষ আর তখনকার পোশাকি ছবির জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিমকে জুটি করে নির্মাণ করলেন ‘সওদাগর’ ছবিটি। মুক্তির পর ছবিটি দেখতে সিনেমা হলে দর্শক রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অঞ্জুর ভিন্নমাত্রার আবেদনময়ী অভিনয়, নাচ আর তির্যক চাহনিতে কুপোকাত দর্শক। ফলে ‘সওদাগর’ সুপারহিট আর অঞ্জু ঘোষ প্রথম ছবিতেই ঢাকাই সিনেমা জগতে নিজের স্বতন্ত্র ও পোক্ত আসন গড়ে নিলেন। তাঁর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া তোজাম্মেল হক বকুল নির্মিত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটি এখনো মাইলফলক হয়ে আছে। তাই বলা যায়, ১৯৮২ সালে অঞ্জু অভিনীত প্রথম ‘সওদাগর’ আর ১৯৮৯ সালের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবি দুটি অঞ্জুর চলচ্চিত্র জীবনের মূল রেকর্ড। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ করে রাতারাতি খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে যান অঞ্জু ঘোষ। এই ছবির ব্যবসায়িক রেকর্ড আজ পর্যন্ত অন্য কোনো ছবি ভাঙতে পারেনি। ছবিটির এই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার কারণে পরে এটি কলকাতায় রিমেক হয়।

 

অঞ্জু ঘোষের সাতসতেরো...

অঞ্জুর প্রকৃত নাম অঞ্জলি ঘোষ। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় তাঁর জন্ম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অঞ্জু এবং তাঁর পরিবার চলে যায় চট্টগ্রামে। সেখানকার কৃষ্ণকুমারী গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হন। আর তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর নাচ শেখা। প্রথমে অঞ্জু ঘোষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরার হয়ে যাত্রায় নৃত্য পরিবেশন শুরু করেন।

পরে চট্টগ্রামে মঞ্চনাটকে নিয়মিত হন। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মোট ছয়টি ভাষার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি বাংলার নীলো নামে পরিচিত ছিলেন। নীলো হলেন পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় একজন নায়িকা। ১৯৮৭ সালে অঞ্জু সর্বাধিক ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮৯ সালে তাঁর অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ অবিশ্বাস্য রকমের ব্যবসা করে এবং সৃষ্টি করে নতুন রেকর্ড। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯০ সালে তাঁর গাওয়া ১২টি গান নিয়ে ‘মালিক ছাড়া চিঠি’ নামের একটি অ্যালবাম প্রকাশ হয়। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানকার চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করে যান। পাশাপাশি সেখানকার যাত্রাপালায়ও অভিনয় করতে থাকেন।

 

২০০৪ সালের দিকে কলকাতার বড় পর্দায়

তাঁর চাহিদা কমলেও যাত্রাপালায় সরব ছিলেন এই অভিনেত্রী। ২০০৮ সাল পর্যন্ত যাত্রা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। কাজের ফাঁকে ২০০২ সালে বিয়ে করেন সহশিল্পী সঞ্জীবকে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত টিকেছিল অঞ্জু-সঞ্জীবের সংসার। একসময় অসহায় ও একাকী জীবন কাটাতে থাকেন অঞ্জু ঘোষ। বর্তমানে অঞ্জু ঘোষের সময় কাটে ধর্মচর্চা আর সংগীতচর্চা করে।

সর্বশেষ খবর