বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

৭১ বসন্তে বিউটি কুইন শাবানা

৭১ বসন্তে বিউটি কুইন শাবানা

আজ ঢালিউডের বিউটিকুইন খ্যাত কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানার জন্মদিন। জীবনের ৭১ বসন্তে পা রাখলেন তিনি। বয়সের অঙ্কে বুড়িয়ে গেলেও এখনো সেই মনকাড়া সৌন্দর্য আর মুগ্ধ করা ব্যবহারে অনবরত নববসন্তে ভাসেন তিনি। আজকের এই বিশেষ দিনে কেমন আছেন সেই শাবানা। সে কথাই তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

জন্মদিনে কী করবেন...

আমেরিকা প্রবাসী শাবানা মুঠোফোনে জানান, জন্মদিন মানে নতুন জীবন পাওয়া আর জীবন থেকে একটি বছর বিয়োগ হওয়া। ছোটবেলা থেকে চলচ্চিত্র জীবন পর্যন্ত খুব ইচ্ছা না থাকলেও সবাই আমার জন্মদিনের আয়োজন করত। একসময় যখন অভিনয় জীবন থেকে দূরে সরলাম তখন থেকে স্বামী, পুত্র, কন্যা আর নাতি-নাতনিরা আমার জন্মদিনের আয়োজন করতে চাইলেও আমি সায় দিই না। এখন বয়স হয়েছে, প্রার্থনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে সুস্থ জীবন কামনা করি। এবার তাই করব। সবাই আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।

 

নিয়মিত দেশের খবর রাখেন...

এখন আমার তারকা হিসেবে ব্যস্ততা নেই। কিন্তু সংসারের ব্যস্ততা তো আছেই। বিদেশে নিজের কাজ নিজে করতে হয়। সন্তানদের দেখাশোনা করি। নিয়মিত নামাজ পড়ি। আর সময় পেলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের খবর জানার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের কোনো ভালো খবর পেলে সেদিন যেন আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকে না।

 

চট্টগ্রামের মেয়ে...

চাকরিজীবী ফয়েজ চৌধুরী এবং গৃহিণী ফজিলাতুন্নেসার ঘর আলো করে ১৯৫২ সালের ১৫ জুন জন্ম হয় আফরোজা সুলতানা রত্নার। চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের ডাবুয়া গ্রামে তাঁর জন্ম।

 

ভিন্ন ধাঁচের এক বিউটিকুইন...

‘আমি ভাত চুরি করি নাই তো। খিদা লাগে, খাই’- প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেনের ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রের এই সংলাপ একজন ক্ষুধার্ত মানুষের অসহায়ত্বের হাহাকার। এমন মর্মস্পর্শী সংলাপ একমাত্র শাবানার মতো একজন বলিষ্ঠ অভিনেত্রীর পক্ষেই পর্দায় জীবন্ত করে তুলে ধরে দর্শকের অশ্রুঝরানো সম্ভব হয়েছে। এই ছবিতে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এলোমেলো জরির জীবনের গল্প করুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। এ কারণেই দর্শকহৃদয় তোলপাড় করার পাশাপাশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন তিনি। চলচ্চিত্রে অভিষেকের ২০ বছর পর সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এই চরিত্রের জন্য বাড়তি নজর কাড়েন শাবানা। এমনটাই জানালেন শাবানার এক গুণমুগ্ধ দর্শক সারাহ তামান্না। শাবানার অভিনয়কে ভালোবেসে অনিন্দ্যসুন্দরী এই অভিনেত্রীকে তাঁর দর্শক-ভক্তরা ‘বিউটিকুইন’ উপাধি দিতে ভোলেননি।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে...

মাত্র নয় বছর বয়সে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের হাত ধরে চিত্রজগতে অভিষেক শাবানার। তখন তাঁর নাম শাবানা নয়, ছিল রত্না। আজিজুর রহমান তাঁকে নিয়ে যান তাঁর গুরু আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের কাছে। এহতেশামের আগ্রহেই ১৯৬১ সালে চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে নাম লেখান তাঁরই পরিচালনার ‘নতুন সুর’ ছবিতে। এরপর ১৯৬৬ সালে ইবনে মিজানের ‘আবার বনবাসে রূপবান’ ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে এবং মুস্তাফিজের ‘ডাকবাবু’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে কাজ করেন তিনি। এহতেশামই পরে তাঁর ‘চকোরী’ ছবিতে প্রধান নায়িকা হিসেবে তাঁকে কাস্ট করে নাম দেন শাবানা। ‘চকোরী’তে প্রধান নারী চরিত্রে নায়ক নাদিমের বিপরীতে লাস্যময়ী তরুণীর সাবলীল অভিনয় দিয়ে শাবানা নজর কাড়লেন দর্শকদের। ৮১ সপ্তাহ ধরে চলা এ ছবিতে চকোরী চরিত্রে শাবানাকে ভালো লেগে যায় দর্শক-নির্মাতার। উর্দু ভাষায় নির্মিত ‘চকোরী’ ছবিটি শাবানার খ্যাতি পৌঁছে দিয়েছিল সুদূর করাচি, পিন্ডি, পেশোয়ার, কোয়েটা, মারি পর্যন্ত। সে বছরই ‘জংলি মেয়ে’, ‘কুলি’, ‘ছোট সাহাব’ মুক্তি পায়। এরপর উর্দু ছবি ‘চান্দ অউর চান্দনি’, ‘পায়েল’, ‘আনাড়ি’, ‘দাগ’-এ অভিনয় করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘বিজলী’ ছবিতে। চার্লস ডিকেন্সের অনবদ্য সৃষ্টি ‘অলিভার টুইস্টে’র ছায়া অবলম্বনে তৈরি এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে সুনাম কুড়ান শাবানা। এ পর্যায়ে এসে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৭০-এ মুস্তাফিজের সঙ্গে ‘একই অঙ্গে এতরূপ’সহ কাজী জহিরের সঙ্গে প্রথমবার কাজ করেন ‘মধুমিলন’ ছবিতে। অভিজাত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে বক্স অফিস ও দর্শকের মনেও জায়গা করে নেন তিনি। তিন দশকেরও বেশি সময় অভিনয়ের ক্ষেত্রে শাবানা একচেটিয়া রাজত্ব করেছিলেন। একাধারে এত রাজত্ব আর কোনো তারকা করতে পারেননি। ১৯৬৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শুধু তাঁর নামেই ছবি চলত। কোনো ছবিতে শাবানা আছেন শুনলেই এখনো টিভির সামনে ভিড় হয় দর্শকের। শাবানা অভিনয় করেছেন ২৯৯টি ছবিতে।

 

আলোচিত চরিত্র

আশির দশকের শুরুতে নায়করাজ রাজ্জাক নির্মাণ করেন আরেক অমর কথাসাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’ অবলম্বনে একই শিরোনামের ছবিটি। এতে ঢালিউডের বিউটিকুইনখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা অভিনয় করেন নাম ভূমিকায়। আর এ চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় আজও চরিত্রটিকে অমর করে রেখেছে। অন্যদিকে বুলবুল আহমেদ নির্মিত শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’ অবলম্বনে ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’ ছবিতে রাজলক্ষ্মী চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকমুগ্ধ করেন শাবানা।

 

যত সম্মাননা...

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সঙ্গে বেশ সখ্যই ছিল শাবানার। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে মোট এগারো বার জয় করে নেন এই সম্মাননা। তবে প্রথমবার ১৯৭৭ সালে প্রত্যাখ্যান করেন ‘জননী’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রের জন্য পাওয়া এ পুরস্কারটি। ১৯৮০ থেকে ৮৪ সাল টানা জয় করেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। এর মাঝে ১৯৯০ সালে সেরা প্রযোজক হিসেবেও জয় করেন এটি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। দশ বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়াও শাবানা পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার (১৯৮২ ও ১৯৮৭), আর্ট ফোরাম পুরস্কার (১৯৮৪, ১৯৮৮), সায়েন্স ক্লাব পুরস্কার (১৯৮৪), কথক একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৯), নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৮৮), প্রযোজক সমিতি পুরস্কার (১৯৯১), কামরুল হাসান পুরস্কার (১৯৮৭), নাট্য নিকেতন পুরস্কার (১৯৮৫), ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৫)। শাবানার ঝুলিতে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, রুমানিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালসহ আরও বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে।

 

বিয়ের পরের কথা

বিয়ে হওয়া মানে যে, ফুরিয়ে যাওয়া নয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শাবানা। ১৯৭৪ সালে এক সুতায় জীবন বাঁধেন সরকারি কর্মকর্তা ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে। পরবর্তীতে দুজনে মিলে গড়ে তোলেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ‘এসএস প্রোডাকশন’। এ সংস্থা থেকে ১৯৭৯ সালে আজিজুর রহমানকে দিয়ে শাবানা প্রথম প্রযোজনা করেন ‘মাটির ঘর’ ছবিটি। প্রায় ২৫টির মতো ছবি প্রযোজনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে যৌথ প্রযোজনার ছবিও রয়েছে। ১৯৯৭ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ছবিই তাঁর অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে সপরিবারে থিতু হন। তাঁর পরিবারে স্বামী ছাড়াও আছেন বড় কন্যা সুমি ইকবাল, ছোট মেয়ে ঊর্মি সাদিক ও পুত্র নাহিন সাদিক। বড় মেয়ে সুমি এমবিএ করেছেন। তিনি গৃহিণী। দ্বিতীয় মেয়ে ঊর্মি হারবার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। ওই ইউনিভার্সিটিতেই তিনি শিক্ষকতা করছেন। একমাত্র ছেলে নাহিন সাদিক ব্লমবার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছেন।

সর্বশেষ খবর