শনিবার, ১৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেই শবনম এখন

সেই শবনম এখন

বরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শবনম এখন কেমন আছেন। ৪০ বছরের বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্র জীবন তাঁর। ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ অভিনয় করেন ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার পর বলতে গেলে অনেকটা অবসর সময় পার করছেন তিনি। এই কিংবদন্তি অভিনেত্রীকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যেভাবে সময় কাটছে এখন

১৯৯৯ সালে ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পর কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনমকে আর ক্যামেরার সামনে দেখা যায়নি। তাঁর কথায় ‘কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে এমন বেসিক চরিত্র পাইনি বলেই অভিনয় থেকে দূরে সরেছি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে যে উচ্চাসন দিয়েছেন সেখানে বসে গতানুগতিক চরিত্রে তো আর অভিনয় করতে পারি না। এই অভিনেত্রী এখন ‘বই পড়া, গান শোনা, টেলিভিশন দেখা, ঘরের কাজকর্ম করা আর নিজের যত্ন নেওয়া নিয়েই অবসর জীবন কাটাচ্ছেন।’ শবনমের কথায় ‘অভিনয় জীবনে অনেক পেয়েছি। তেমন কিছু চাওয়ার নেই। তবে যত দিন বাঁচি যেন সুস্থ থাকি, এটাই প্রত্যাশা করি। এ জীবনে কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো ব্যথা নেই। অনেক পেয়েছি। ‘দীর্ঘ অভিনয় জীবনে মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তাতে আমি কৃতজ্ঞ। দুই দশকের বেশি সময় সিনেমার বাইরে, তারপরও সবাই আমাকে মনে রেখেছেন, এটাই আমার অনেক বড় প্রাপ্তি। বহুদিন পর সিনেমার মানুষের কাছে এসে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তাতে সবার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকব। আমি যেভাবে নিজের বাসায় চুপচাপ আছি, সেভাবেই ভালো আছি। শান্তিতে আছি। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে চাই না। আমি শিল্পী। আমি আমার মতো আছি। খুব ভালো আছি। আমার পরিবার, শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন নিয়ে ভালোই আছি। বাসায় থাকি। টেলিভিশন দেখি। গান শুনি। রান্না করি। ছেলে ঢাকায় এলে তার জন্য রান্না করি। কখনো কখনো নিজের জন্য রান্না করি। জীবন তো চলেই যায়। নিজের পুরনো ছবিগুলো দেখি। রবিনের গান অনেক শুনি। আলাউদ্দীন আলী, খান আতাউর রহমানের গানও শুনি। স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি। কাউকে বিরক্ত করছি না। চলচ্চিত্রে আমাদের সময়কার সেই সোনালি দিনের কথা মনে করে এখন শুধু দুঃখ পাই আর নীরবে কাঁদি। এই কান্নার শেষ কখন হবে জানি না।

 

রূপনগরের রাজকন্যা হয়ে এলেন

‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি, ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি’... কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম এই গানে ঠোঁট মিলিয়ে এ দেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। দর্শকমনে শিহরণ জাগান। এটিই ছিল তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ‘হারানো দিন’-এর গান। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ১৯৬১ সালে পরিচালনা করেন ছবিটি। প্রথম ছবিই সুপারহিট। তারপর শুধুই দর্শকমন জয় করে এগিয়ে যাওয়া। নব্বই দশক পর্যন্ত পাকিস্তান আর বাংলাদেশে প্রায় ১৮৫টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী যিনি কি না পাকিস্তান চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা নিগার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন ১২ বার। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মিলিয়ে অসংখ্য নানা সম্মাননায় সমৃদ্ধ হয় তাঁর অর্জনের ঝুলি। অনুষ্ঠানে নিজের একটি লিখিত বক্তব্যও পড়ে শোনান শবনম। সেখানে তিনি বলেন, খ্যাতিমান এই অভিনেত্রীর প্রকৃত নাম ঝর্ণা বসাক। তবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অভিনয় জগতে তিনি শবনম নামে পরিচিত। এই নামে তাঁকে মুসলিম ধর্মের মনে হলেও আসলে তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। নব্বইয়ের দশক থেকে শবনম বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার আগে কাজ করতেন পাকিস্তানি ছবিতে।

 

যেভাবে ঝর্ণা বসাক হলেন শবনম

ঝর্ণা বসাক ১৯৪০ সালের ১৭ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন ঢাকায়। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ক্যাপ্টেন এহতেশামের চান্দা ছবিতে ১৯৬২ সালে অভিনয় করেন শবনম। এই নির্মাতাই ‘হারানো দিন’ ছবিতে তাঁকে শবনম নামটি দেন। শবনম নামের অর্থ হলো ফুলের মধ্যে বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়া। চান্দা ছবিটিও দর্শক বিপুলভাবে গ্রহণ করলে অভিনেত্রী শবনমের শুরু হয় রুপালি পর্দায় শুধুই সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠা। ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর শবনম বিয়ে করেন খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক রবীণ ঘোষকে। ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন রবীণ ঘোষ। একমাত্র পুত্র রনি ঘোষকে নিয়ে ঢাকার বারিধারার ডিওএইচএসে সময় কাটছে এখন এই কিংবদন্তির। শবনমের একমাত্র বড় বোন নন্দিতা দাস কলকাতার সিমলা রোডে বাস করেন। মাঝে মধ্যে বোনের কাছে বেড়াতে যান তিনি। এই অভিনেত্রীর বাবা ননী বসাক ছিলেন একজন স্বনামধন্য স্কাউট প্রশিক্ষক ও ফুটবল রেফারি।

 

১৯৬৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবাসী

১৯৬৮ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম ললিউডে (লাহোর) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। ১৯৮৮ সালে শবনম ঢাকা ও লাহোরের চলচ্চিত্রে একসঙ্গে অভিনয় করতে থাকেন। প্রায় ৪০ বছরের অভিনয় জীবনে ১৮৫টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। আশির দশকে ঢাকায় এসে অভিনয় করেন শর্ত, সন্ধি, সহধর্মিণী, যোগাযোগ, আমার সংসার, চোর, জুলি ছবিতে। নব্বই দশকের শেষভাগে ঢাকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ছবিটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায় এবং শবনম এ প্রজন্মের দর্শকদের কাছেও সমান জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে শবনম বলেন, ‘আমার ভাগ্য ভালো যে, আমার অভিনীত প্রথম ও শেষ ছবি ছিল আমার ক্যারিয়ারের সেরা ছবি।’

 

চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে যা বললেন

শবনম বললেন, চলচ্চিত্র বলতে বুঝি এহতেশাম, মুস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, রহমান, এ জব্বার খান, নাদিম, সুচন্দা, কবরী, ববিতা, রাজ্জাক, আলমগীর মানে প্রথমদিকে যাঁরা চলচ্চিত্রে এসেছিলেন, তাঁদের নাম। আমার স্বামী রবীণ ঘোষ বেঁচে থাকতে এবং মারা যাওয়ার পরও তাঁর কোনো মূল্যায়ন হলো না, এ কথা ভাবতেই খুব দুঃখ লাগে। দীর্ঘদিন আগে একবার এফডিসির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, গাড়ি ঘুরিয়ে ভিতরে গোপনে ঢুকলাম। সাউন্ড রুমের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছি। এফডিসির বেহাল এই অবস্থা মানতে পারিনি। এক দিন শুনবেন, আমি মরে গেছি। আমি তো আমার ছেলেকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি, আমার মরদেহ যেন কোনোভাবেই এফডিসিতে না যায়। আমার স্বামী, প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবীণ ঘোষও বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মরদেহও যেন সেখানে নেওয়া না হয়, তাই নেওয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, মরে গেলে ফুলের মালা দেবে, হয়ে গেল, তাই না? এই সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না। কাউকে আমার মরদেহ নিয়ে মায়াকান্না করার সুযোগ দেব না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর