সোমবার, ৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রে ভিন্নধারার গল্পে বাজিমাত

আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রে ভিন্নধারার গল্পে বাজিমাত

সুড়ঙ্গ

চলচ্চিত্রকার আর দর্শকদের একটিই কথা- ‘ভালো  গল্প আর মানসম্মত ছবি পেলে সবাই তা সাদরে গ্রহণ করে।’ সম্প্রতি আবারও এ কথার প্রমাণ মিলেছে। ঈদে মুক্তি পাওয়া প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ, লাল শাড়ি, প্রহেলিকা ও ক্যাসিনো- এই পাঁচ ছবির  প্রতি দর্শক আগ্রহ তাই বলছে। দর্শকের দাবি প্রিয়তমা প্রেমের গল্পের ছবি হলেও গল্প ও নির্মাণে নতুনত্ব আছে। গল্পে যথেষ্ট টুইস্টও আছে। আর এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে শাকিবের ভিন্ন লুক। সুড়ঙ্গ রহস্যে ভরা গল্পের ছবি। এতে ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা আফরান নিশোর সপ্রতিভ উপস্থিতি ও গল্পের নতুন আঙ্গিকের কারণে দর্শক ছবিটি দেখতে ছবিঘরে ভিড় করছে। লাল শাড়ি ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে চিরায়ত বাংলার বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য তাঁত শিল্প ও এর সঙ্গে যুক্তদের সুখ-দুঃখের গল্প নিয়ে। তাই বাংলার মাটির গন্ধমাখা এই ছবির গল্প বাঙালিকে সিনেমা হলে যেতে সহজেই উৎসাহ জোগাচ্ছে। প্রহেলিকা ছবিটির গল্প প্রথম থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত অন্যরকম রহস্যের আবরণে মোড়া। তাই দর্শক টানটান উত্তেজনায় ছবিটি দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। ক্যাসিনো ছবিটি এ দেশে ঘটে যাওয়া ক্যাসিনো কান্ড ও মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও বলিষ্ঠ প্রতিবাদের অগ্নিরূপ। তাই দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছবিটি দেখছে ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি ছবিতে জীবনবোধের গল্প ওঠে আসা এবং দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড বলেন, বদলে যাচ্ছে ঢাকাই সিনেমার গল্প। সময়ের পথে হেঁটে নতুনত্বের কাঁধে ভর করে এ বদলের হাওয়া লেগেছে। উদ্ভট ও অবাস্তব গল্পের পরিবর্তে জীবনের গল্প নিয়ে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো নির্দ্বিধায় দর্শকগ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। আসলে আমাদের দেশে মৌলিক ও জীবনধর্মী গল্পের অভাব নেই। দর্শক চলচ্চিত্রে নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে দেখতে চায়। আয়নায় আপন চেহারা দেখার মতো যখন ছবিতে নিজেদের চিরচেনা জীবনচিত্র খুঁজে পায় তখনই তারা সেই ছবি দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর তখনই ছবিটি সফল হয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়। এসব ছবিতে থাকে নিজ দেশের কৃষ্টি ও কালচারের জয়গান। কিছুদিন আগে কয়েকটি বিদেশি পত্রিকা বাংলাদেশের তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রশংসা করে প্রতিবেদন ছেপেছিল। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বলিউড বা হলিউড কিংবা অন্য যে কোনো দেশের চলচ্চিত্রকে অনুকরণ না করে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতারা গল্প বলার ক্ষেত্রে নিজস্ব ভঙ্গি  তৈরি করেছেন। পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল ডেইলি স্ক্রিন’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলা চলচ্চিত্রের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের নির্মাতারা এখন ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প বলছে। এটা ওই দেশের সিনেমার জন্য শুভ লক্ষণ। দীর্ঘদিন পর ভালো গল্পের ছবি পেয়ে সিনেমা হলে ভিড় জমিয়েছে দর্শক। আসলে কেমন গল্পে সিনেমা হলে ফিরবে দর্শক? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন কয়েকজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায় চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। চলচ্চিত্রে ফুটে উঠবে যাপিত জীবনের পারিপার্শি^কতা। যা দেখে দর্শক তার আশপাশের চিত্র খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ, আবেগপ্রবণ বা আনন্দিত হবেন। এ জন্য সমসাময়িক জীবনের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। একসময়  সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ জামান চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, এ টি এম শামসুজ্জামান, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, আবদুল জব্বার খান, আমজাদ হোসেনের মতো গল্পকারদের গল্পে কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। এখন গল্পকারের আকাল চলছে। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ছটকু আহমেদ আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগের পর দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখা শুরু হয়। কতিপয় নির্মাতা মৌলিক গল্পবিবর্জিত হিন্দি ছবির অনুকরণ আর নকল করতে গিয়ে গাঁজাখুরি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়ে। মাঝে মধ্যে দুই-একটি পারিবারিক গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প। আর এই ভালো ছবিগুলোই খরার মাঝে স্বস্তির বৃষ্টি বয়ে আনে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আমাদের চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এই সমৃদ্ধতা গড়ে ওঠেছে নিজস্ব গল্প, সংস্কৃতির ছাপ আর পারিপার্শ্বিক ছায়ার ওপর ভর করে। এ কারণেই এ দেশের ছবি একসময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসায় ভাসত, দেশের দর্শক আনন্দ-উচ্ছ্বাস নিয়ে ছবিঘরে ছুটে গিয়ে নিজের জীবনকে রুপালি পর্দায় খোঁজে পেয়ে তৃপ্ত হতো। সেই অবস্থা ফেরানো কঠিন নয়, বিবেক আর মেধাই এর জন্য যথেষ্ট। এমন ছবি পেলে নির্র্দ্বিধায় সিনেমা হলে ফিরবে দর্শক। যার প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া কয়েকটি ছবি। আশা করি এই ভালো গল্পের ছবির যাত্রা অব্যাহত থাকবে। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মিত হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত ছবির গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মতো দর্শকদের সিনেমা হলে টেনে নিয়ে যেত। জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের ছবিতে নিজের ও নিজের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র দেখতে পেয়ে আপ্লুুত দর্শক হেসে-কেঁদে সিনেমা হল থেকে বের হতো। একটি ছবি বারবার দেখত। এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র প্রয়াত আবদুল জব্বারের ‘মুখ ও মুখোশ’। একজন ডাকাতের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও এটি ছিল পারিবারিক গল্পের ছবি। একটি সমৃদ্ধ ও সময়োপযোগী গল্প পেয়ে দর্শক সাদরে গ্রহণ করে ছবিটি। এই ধারাবাহিকতায় নির্মিত হতে থাকে এ দেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, সুতরাং, বেহুলা, মনের মতো বউ, রূপবান, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আবার তোরা মানুষ হ, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভাত দে, সারেং বৌ, অবুঝ মন, ময়নামতী, ছুটির ঘণ্টা, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, অশিক্ষিত, অশ্রু দিয়ে লেখা, স্বরলিপি, হাজার বছর ধরে, হাছন রাজা, নবাব সিরাজদ্দৌলা, জীবন থেকে নেয়া, সাতভাই চম্পা, মনপুরা, আয়নাবাজি, পরাণ, হাওয়া, গলুই, পদ্মাপুরাণ, নোনা জলের কাব্য, লাল মোরগের ঝুঁটি, চন্দ্রাবতী, মোল্লাবাড়ির বউ, হৃদয়ের কথা, গঙ্গাযাত্রা, অন্তর্ধান, ভুবন মাঝি, নাচোলের রানী সত্তা, ঢাকা অ্যাটাক, মিশন এক্সট্রিম, লিডার আমিই বাংলাদেশ, রিকশাগার্ল, ঊনপঞ্চাশ বাতাস, স্বপ্নবাজি, মায়া দ্য লস্ট মাদার, মৃত্তিকামায়া প্রভৃতি ছবি। ১৯৯২ সালে নতুন ধারার গল্পের ছবি ‘শঙ্খনীল কারাগার’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ছবির মর্যাদা লাভ করে। নতুন ধারার গল্পের ছবির এই দর্শকপ্রিয়তা এখনো অব্যাহত আছে।

সর্বশেষ খবর