সোমবার, ১০ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

যেমন আছেন অভিনেত্রী অলিভিয়া

যেমন আছেন অভিনেত্রী অলিভিয়া

‘দি রেইন’ ছবিতে অলিভিয়া ও ওয়াসিম

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের মধ্যে অন্যতম অলিভিয়া। দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন তিনি।  অন্তরালে থাকা এই অভিনেত্রী কেমন আছেন এখন? অভিনয় জীবনের শুরুতেই গ্লামার আর অভিনয়দক্ষতা দিয়ে দর্শকহৃদয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান গড়ে নেওয়া এবং দর্শকপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায়ই চলচ্চিত্র ছেড়ে যাওয়া অভিনেত্রী অলিভিয়ার কথা তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যেমন আছেন এখন

অভিনেত্রী অলিভিয়া দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রে নেই। ফিল্মের লোকজনের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ নেই। এমন কি সংবাদকর্মীদেরও দেখা দেন না এবং তাঁদের সঙ্গে কথাও বলেন না। খুব কাছের মানুষ ছাড়া অন্য কেউ তাঁর ছায়াও মাড়াতে পারেন না। এ যেন ওপার বাংলার কিংবদন্তি অভিনেত্রী প্রয়াত সুচিত্রা সেনের পথ ধরে হাঁটা। তাঁর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম অভিনেত্রী ববিতা বলেন, আমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় তাঁর। এখনো আগের মতোই হাসিখুশি আছেন। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখেই কাটছে তাঁর জীবন। অভিনেত্রী হিসেবে যেমন বাস্তবেও অসাধারণ ভালো মনের মেয়ে অলিভিয়া। বর্তমানে বসবাস করছেন বনানীর ডিওএইচএস-এর বাড়িতে। ববিতা বলেন, একবার অলিভিয়া বলেছিলেন, ‘ফিল্মে যোগ দিয়েছিলাম নেহাত শখের বশে। ৫৩টির মতো ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম চিত্রপরিচালক এস এম শফিকে। যদিও আমাদের সন্তানাদি ছিল না, তবুও সুখী হতে পেরেছিলাম। স্বামীর মৃত্যুতে আমি ভেঙে পড়ি। সেই শোকে এক দিন ফিল্ম জগৎ ছেড়ে দিলাম...।’

 

কেন চলচ্চিত্র ছাড়লেন

প্রথম স্বামী চিত্রপরিচালক এস এম শফির মৃত্যুর পর চলচ্চিত্র ত্যাগ করেন অলিভিয়া। চলচ্চিত্রকার এস এম শফিকে ভালোবেসে ১৯৭২ সালে বিয়ে করেন তিনি এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান শফি। এরপর শোকাহত অলিভিয়া চলচ্চিত্র জগৎ ত্যাগ করেন। পরে বিয়ে করেন ফতুল্লার মুনলাইট টেক্সটাইল মিলের কর্ণধার হাসানকে। বর্তমানে বসবাস করছেন বনানীর ডিওএইচএস-এর বাড়িতে। ধর্ম-কর্ম পালন ও সংসার নিয়েই পরম সুখে কাটছে তাঁর জীবন। ‘আয়রে মেঘ আয়রে’, কিংবা ‘পরদেশি মেঘরে আর কোথা যাসনে, বন্ধু ঘুমিয়ে আছে দে ছায়া তারে’...।’ ‘দ্য রেইন’ ছবির এই গানগুলো এখনো একজন সুশ্রী অভিনেত্রীর কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি হলেন অলিভিয়া। সত্তরের দশকে চলচ্চিত্রে আসা জনপ্রিয় নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন এই অভিনেত্রী। ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় তাঁর সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্র ‘দুশমনি’। এরপর থেকে এই অভিনেত্রী পর্দা কিংবা বাস্তবে আর কারও মুখোমুখি হননি। অনেকটা নীরবে-নিভৃতেই কাটছে তাঁর বর্তমান দিনকাল।

যেভাবে চলচ্চিত্রে

খ্রিস্টান মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অলিভিয়া গোমেজের জন্ম ১৯৫৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি করাচিতে। মা-বাবার আদি নিবাস ভারতের গোয়ায়। ছোটবেলায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে মডেলিং শুরু করেন। অলিভিয়া পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় এসে হোটেল পূর্বাণীতে রিসিপশনিস্ট পদে চাকরি করেন কিছুদিন। চাকরিরত অবস্থায় কয়েকটি বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। ১৩-১৪ বছর বয়স থেকে মডেলিং করা শুরু করেন। একটা চাকরি প্রয়োজন ছিল বলেই পূর্বাণী হোটেলের রিসিপশনিস্ট হয়েছিলেন। হোটেল পূর্বাণীতে একবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এস এম শফি এলেন। তিনি অলিভিয়াকে দেখে বললেন, ‘ফিল্মে অভিনয় করবে নাকি’। কথাটা শুনে অলিভিয়া ভাবলেন, এতদিনের চাওয়া-পাওয়া তাহলে এবার পূর্ণ হবে। শুরু হলো অলিভিয়াকে নিয়ে শফির ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ ছবির কাজ। দুজন নায়িকা, দুজন নায়ক। রাজ্জাকের নায়িকা হলেন শাবানা আর ওয়াসিমের নায়িকা হলেন অলিভিয়া। এরপর টাকার খেলা, মাসুদ রানা, সেয়ানা, দি রেইন, বাহাদুর ছবিতে অভিনয় করলেন। এই ছবিগুলো নির্মিত হয় ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে। তখন অলিভিয়ার অসম্ভব খ্যাতি। যখন যেখানে গিয়েছেন সেখানেই জনতার ভিড় উপচে পড়ত। ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ ছবিতে অভিনয়ের আগে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ এবং বেবি ইসলামের ‘সংগীতা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল তাঁর। সব ঠিকঠাক, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ছবিগুলো থেকে বাদ পড়লেন তিনি। এরই এক বছর পর ১৯৭২ সালে ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ ছবিতে অলিভিয়া নায়িকা হয়ে এলেন। ৫৩টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এই জননন্দিত অভিনেত্রী। পোশাকি, ফ্যান্টাসি এবং সামাজিক- সব ধরনের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন এবং গ্লামার নায়িকা হিসেবেই  প্রতিষ্ঠা পান তিনি। নায়ক ওয়াসিমের সঙ্গে তাঁর জুটি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া এই জুটির ‘দি রেইন’ ছবিটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগায়। অলিভিয়ার স্বামী এস এম শফি তাঁর গ্লামার এবং যৌন আবেদনকে ব্যবহার করতে কার্পণ্য করেননি। তবে অলিভিয়া শক্তিশালী অভিনয়ের পরিচয় দেন রাজ্জাকের বিপরীতে ‘যাদুর বাঁশী’ ছবিতে। ‘টাকার খেলা’, ‘বাহাদুর’ ও ‘দি রেইন’ ছবি তিনটি করার পর অলিভিয়া ঢাকা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আবেদনময়ী নায়িকা হিসেবে পরিচিতি পেলেন। ‘বাহাদুর’ ছবিতে অলিভিয়া এতটা খোলামেলা হলেন যে, তাঁকে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। ১৯৭৬ সালে ‘দি রেইন’ ছবিতে অভিনয় করে অসম্ভব খ্যাতি পেলেন তিনি। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল অলিভিয়া নামটি।

 

কলকাতায় উত্তম কুমারের বিপরীতে

ববিতার পর অলিভিয়া ছিলেন একমাত্র নায়িকা যিনি তখন কলকাতার ছবিতে অভিনয় করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ছবির নাম ‘বহ্নিশিখা’। এ ছবির নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। ১৯৭৬ সালের সিনেমা ‘বহ্নিশিখা’। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গল্প অবলম্বনে নির্মিত সেই সিনেমায় উত্তম কুমারের সঙ্গে আরও ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী ও রঞ্জিত মল্লিক। সিনেমায় উত্তমের নায়িকা ছিলেন অলিভিয়া। সেবারই প্রথম ও শেষবারের মতো কোনো বাংলাদেশি নায়িকার বিপরীতে কাজ করেন মহানায়ক উত্তম কুমার।

 

পারিবারিক জীবন

করাচি থেকে ঢাকায় আসার পর পরিবারের সঙ্গে থাকতেন মগবাজারের ইসলামী কলোনিতে। তার বাবা চাকরি করতেন দ্য ডেইলি অবজারভার পত্রিকার রিডিং সেকশনে। ছোট ভাই থাকেন আবুধাবিতে। বড় ভাই অভি ও আরেক ভাই ফুটবলার জর্জি ঢাকায়ই থাকেন। অলিভিয়ার চার বোনের মধ্যে বড় বোন থাকতেন কলকাতায়। ২০১১ সালে তিনি মারা যান। মেজো বোন অডিট ছিলেন বিমানের ক্যাবিন ক্রু। আমেরিকায় থাকতেন। ছোট বোন অলকা থাকতেন কানাডায়। অভিনেত্রী অলিভিয়া দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও পরিবার নিয়ে পরম শান্তিতে আছেন, এটিই তাঁর দর্শক-ভক্তদের জন্য অপার আনন্দের খবর।

সর্বশেষ খবর