শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

যার সুরের জাদুতে মাতোয়ারা বিশ্ব

যার সুরের জাদুতে মাতোয়ারা বিশ্ব

সুরের জাদুকর এ আর রহমান সেবামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ‘মানবপ্রেমী’ আখ্যাও পেয়েছেন। শৈশব থেকে চরম দরিদ্রতা তাকে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছে। সেই যুদ্ধে একদিন বিশ্বজুড়ে বিজয়ী হয়ে ওঠলেন তিনি। মানবপ্রেমী এ আর রহমানের অতলান্ত সাংগীতিক বিস্ময়ের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

মানবপ্রেমী

এ আর রহমান মানবপ্রেমী আখ্যাতেও ভূষিত হয়েছেন। বেশকিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রহমান ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘স্টপ টিবি’ কার্যক্রমের বৈশ্বিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। এ ছাড়াও ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এবং ‘ইন্ডিয়ান ওশেন’ নামক ভারতভিত্তিক বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ২০০৪ সালে সুনামি আক্রান্ত মানুষের জন্য ও বিভিন্ন সময় অনাথ শিশুদের সাহায্য করার জন্য কনসার্টের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেন রহমান। দরিদ্র ও নিপীড়িত জনগণের সাহায্যার্থে নির্মিত ফিচার ফিল্মে বিনা পারিশ্রমিকে সংগীত পরিচালনা করেন এ আর রহমান। ২০০৬ সালে চেন্নাইয়ের দরিদ্র নারীদের সাহায্য করার জন্য ‘দ্য বানায়ান’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের থিম মিউজিক রচনা করেন তিনি। ২০০৮ সালে ‘ফ্রি হাগ ক্যাম্পেইন’ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে রহমান ও শিভামানি ‘জিয়া সে জিয়া’ শীর্ষক একটি গান রচনা করে ভারতের বিভিন্ন শহরে তার প্রচারণা চালান।

 

যেভাবে প্লেব্যাকে

প্লেব্যাক বা চলচ্চিত্রের গানে এ আর রহমানের আত্মপ্রকাশ বম্বে (তামিল, ১৯৯৫) ছবিতে। এর আগে তিনি অনেক গানের কোরাসে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম কোনো গানে পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা পালন করেন বম্বে সিনেমার হাম্মা হাম্মা গানটিতে। মুভি বোম্বের (১৯৯৫) তু হি রে... গানটি এবং বোম্বে থিম মিউজিক ট্র্যাক তার অনন্য দুটি সৃষ্টি।

 

সফলতার শুরু

১৯৮৭ সালে রহমান আলৌইন শীর্ষক একটি জিঙ্গেল কম্পোজের সুযোগ পান যা বেশি মানুষের কাছে পরিচিতি পেতে সহায়তা করে। তখনই তিনি পরিচালক মনি রত্নমের নজরে আসেন। রত্নম তার তামিল ‘রোজা’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার সুযোগ দেন রহমানকে। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এ আর রহমানকে। রোজা নির্মাণের সময়ই চিত্রনাট্যকার সন্তোষ শিবান মালায়লাম চলচ্চিত্র ‘যোধা’তে এ আর রহমানকে চুক্তিবদ্ধ করেন। এটি মুক্তি পায় ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পরই জীবনের মোড় ঘুরে যায় এ আর রহমানের। ‘রোজা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জয় করেন ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা সংগীত পরিচালকের পুরস্কার।

 

অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর

১৯৯৭ সালের ১৫ আগস্ট তার কণ্ঠে প্রথম অ্যালবাম বের হয় ‘বন্দে মাতরম’ শিরোনামে সনি মিউজিক কোম্পানির পক্ষ থেকে। বন্দে মাতরম মাইলস্টোন অ্যালবামটি শুধু ইন্ডিয়াতে তখন বিক্রি হয়েছিল ১.২ কোটি পিস। ১৯৯৯ সালে জার্মানির মিউনিখে কনসার্টে মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে পারফর্ম করেছেন তিনি। ২০০২-এ বিশ্ববিখ্যাত কম্পোজার অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রিলিজ দেন তার প্রথম স্টেজ প্রডাকশন বোম্বে ড্রিমস। ২০০৭ সালে তাজমহলকে দ্য নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স-এ স্থান পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রমোশন হিসেবে ওয়ান লাভ গানটি ৬টি ভাষায় রিলিজ দেন।

মণি রত্নমের ‘রোজা’ সিনেমার দুটি গান জিতেছিল দুটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। জিতেছেন একটি বাফটা, গোল্ডেন গ্লোব, চারটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ও ফিল্মফেয়ারসহ অসংখ্য পুরস্কার। এ ছাড়া ২০০৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সেরা ১০ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকায় তার নাম স্থান পায়। ২০১০ সালে রাষ্ট্রীয় উপাধি ‘পদ্মভূষণ’ অর্জন করেন। সম্প্রতি ব্রিটেনভিত্তিক একটি ম্যাগাজিন তাকে ‘টুমরোস মিউজিক আইকন’ উপাধি দিয়েছে।

 

 

ডাবল অস্কার হাতে

আন্তর্জাতিক আইকন

৮১তম অস্কারের মিউজিক ক্যাটাগরিতে ডাবল অস্কার বিজয়ী ভারতীয় এ মিউজিশিয়ান প্রথমে কি-বোর্ড প্লেয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেন। বিশ্ব সংগীতে অবদান রাখার জন্য ২০০৬ সালে ‘স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের’ পক্ষ থেকে রহমানকে একটি সম্মানসূচক অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। তা ছাড়া মিডলক্সে বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, আন্না বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। দুবারের অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে হোয়াইট হাউসে ডিনারের দাওয়াতও পেয়েছিলেন। ২০১৩ সালের নভেম্বরে তার নামে মার্কহাম, ওন্টারিও, কানাডায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়।

 

লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে এ আর রহমান

অসাধারণ ভোকালিস্ট

কম্পোজিশনের পাশাপাশি তিনি একজন অসাধারণ ভোকালিস্টও; হাইপিচ, স্পিরিচুয়ালিটি তার কণ্ঠের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ আর রহমানের কণ্ঠের প্রথম গান মুভি বোম্বের (১৯৯৫) হাম্মা হাম্মা। তবে বন্দে মাতরম (বন্দে মাতরম), লুকা ছুপি (রাঙ্গ দে বাসন্তী), তেরে বিনা (গুরু), খাজা মেরে খাজা (যোধা আকবর), ও... সয়া (স্লামডগ মিলিয়নিয়ার), রেহনা তু (দিল্লি-৬) ইত্যাদি ট্র্যাকগুলোকে তার ভোকাল মাস্টার পিস বলা যেতে পারে। তিনিই একমাত্র ইন্ডিয়ান মিউজিশিয়ান, যার অ্যালবাম বিশ্বজুড়ে ২০ কোটি কপির চেয়েও বেশি বিক্রি হয়েছে।

 

হতে চেয়েছিলেন ড্রাইভার

সে সময় ইলাইয়ারাজার টিমের লিড কি-বোর্ড প্লেয়ার ভিজি ম্যানুয়াল তাকে জিঙ্গেলে (বিজ্ঞাপনের মিউজিক) ক্যারিয়ার আরম্ভ করার পরামর্শ দেন। তখন তিনি বিষয়টি সিরিয়াসলি নেন এবং ভেবে রাখেন যে, এ লাইনে সফল না হলে ড্রাইভিং শিখবেন এবং একজন ড্রাইভার হিসেবে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নেবেন। ১১ বছর বয়স থেকে শুরু করে তিনি দীর্ঘদিন তালিম নেন প্রখ্যাত শিল্পী মাস্টার ধনরাজের কাছে। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ধনরাজ। তার কাছে তালিম নিয়ে নিজস্ব গানের দলও করেছিলেন দিলীপ। এ ছাড়া নিজের শহর চেন্নাইয়ের (তখন অবশ্য মাদ্রাজ) বিভিন্ন ব্যান্ডেও কি-বোর্ড বাজাতেন।

 

অজানা যত তথ্য

কানাডার মারখামের একটি রাস্তার নামকরণ ২০১৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে করা হয়েছে তার নামে। এ আর রহমানের জন্মদিন আর তার ছেলে আমিনের জন্মদিন একই দিনে। শুধু ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ নয়, এ আর রহমান সুর করেছেন হলিউডের জনপ্রিয় মুভি ‘১২৭ আওয়ারস’ এবং ‘লর্ড অব ওয়ার’-এ।

সর্বশেষ খবর